উলুধ্বনি হল বাংলা-সহ, অসম, ওড়িশা, কেরালা ও তামিলনাডুর একটি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা। বিবাহ ও অন্যান্য উৎসবে মহিলারা মুখে ‘উলুলুলুলু’' ধ্বনি উচ্চারণ করেন। এটিকে উৎসব ও সমৃদ্ধির প্রতীক মনে করা হয়।
কীভাবে এই উলুধ্বনির প্রচলন ঘটল? বৈষ্ণব সমাজে প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, কোনও এক সময়ে এক বনে, একজন ব্রাহ্মন ও তাঁর কন্যা বসবাস করতেন। ব্রাহ্মন ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রতিদিন শুদ্ধ মনে তিনি শালগ্রাম শিলাটিকে পুজো করতেন অত্যন্ত ভক্তি ভরে। তাঁর কন্যাও ছোটবেলা থেকেই তাঁর পিতাকে নারায়ণ ভক্তি করতে দেখে, নিজেও নারায়ণের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
এভাবেই কাটতে থাকে তাঁদের সময়। ক্রমে ক্রমে কন্যাটি বালিকা থেকে যুবতীতে পরিণত হন। ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় তিনি অনন্যা হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে একদিন ওই বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সেই সুন্দরী কন্যার দিকে দৃষ্টি পড়ল এক রাক্ষস বংশীয় রাজার। তিনি সেই কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদে এবং বিবাহও করে ফেললেন। রাজার শর্ত ছিল, ব্রাহ্মন কন্যা এখন রাক্ষস বংশের অধীনস্ত মহারানি, সুতারাং সেখানে কোনও দেবতার পুজো করা নিষিদ্ধ।
কন্যা অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে সারা দিন নারায়ণ শিলার সামনে অশ্রু বিসর্জন করতেন এবং নিজের ভাগ্যের উপর কটাক্ষ করতেন। এরই মধ্যে একদিন রাক্ষসরাজ ঘোষণা করলেন, তিনি কিছু দিনের জন্য রাজ্যের বাইরে যাবেন এবং রানিকে তিনি আগে থেকেই সতর্ক করলেন যে, তার অনুপস্থিতিতে কোনও দেবদেবীর উপাসনা যেন না হয়। কিন্তু যেই মাত্র রাজা মহলের বাইরে চলে গেলেন, অমনি রানি তাঁর নারায়ণ শিলাটি বাইরে বার করে তিলক চন্দন অর্পন করে পুজো শুরু করলেন। নারায়ণ মন্ত্রে গুঞ্জরিত হল চারিদিক।
ওদিকে কিছু দুর না যেতেই ফিরে এলেন রাক্ষসরাজ এবং ফিরে এসে রানিকে নারায়ণের পুজো করতে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। আদেশ করলেন, এই মুহূর্তেই যেন নারায়ণ শিলাকে গঙ্গায় বিসর্জন করা হয়। অগত্যা, কোন উপায় না দেখে রানি মাথায় করে শিলাটিকে নিয়ে গঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করলেন। তবে তাঁর মনে ছিল অন্য অভিসন্ধি। মনে মনে তিনি নারায়ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের প্রানও বিসর্জন দেবেন বলে ভাবতে থাকেন। এভাবেই, গঙ্গায় নেমে, রানি হাঁটুজল থেকে কোমর জল, কোমর জল থেকে আকণ্ঠ জলে যখন নামলেন। তখন দূর থেকে দৈববাণী হল ‘হে কন্যা, তোমাকে তোমার প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে না। তুমি এই শিলাটিকে ফের তোমার গৃহে বহন করে নিয়ে যাও। তুমি যদি আমাকে পুজো নিবেদন করতেই চাও, তাহলে তোমাকে কোনও মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে না। তুমি যখনই আমার পুজো করতে চাইবে, তখন শুধুমাত্র তোমার মুখ দিয়ে কয়েক বার উলুধ্বনি করো। তাহলেই আমি তোমার সমর্পন গ্রহণ করব। শুধু তুমিই নও, এই উলুধ্বনি করার অধিকার আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত নারীকে প্রদান করলাম। যে কোনও নারী একবার উলুধ্বনি করলেই আমি তাঁর সমর্পন গ্রহণ করব।’
এর পরে ব্রাহ্মন কন্যা তথা রাক্ষসরানি সানন্দে তাঁর গৃহে পদার্পন করলেন এবং বাকি জীবনটা তিনি শুধুমাত্র উলুধবনির মাধ্যমে নারায়ণকে পুজা করলেন। তাঁর জীবনাবসানের পর ঠাই পেলেন স্বয়ং নারায়নের পদপাদ্মে।