ভাইবোনের অটুট বন্ধন, আনন্দ ও খুনসুটির আর এক উৎসব ভাই ফোঁটা। পশ্চিমবঙ্গে সাড়ম্বরে এই উৎসব পালিত হলেও, বাংলার বাইরে, উত্তর ভারতেও ভাই ফোঁটার প্রচলন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এর নাম হয়ে যায় ভাই দুজ, ভাই বীজ, দক্ষিণ ভারতে এটি আবার যম দ্বিতীয়া নামে পরিচিত। তবে নাম যাই হোক না-কেন, ভাইয়ের মঙ্গল কামনা ও দীর্ঘায়ুর লাভের কামনা করে এ দিন প্রতিটি বোন নিজের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয়।
প্রতি বছর কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভাই ফোঁটা বা ভাই দুজ পালিত হয়। চলতি বছর ৬ নভেম্বর ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া। ৬ নভেম্বর সারাদিন ফোঁটা দেওয়া যাবে। তবে এর মধ্যে সর্বাধিক শুভ সময় জেনে নিন—
দ্বিতীয়া শুরু- ৫ নভেম্বর রাত ১১টা ১৮ মিনিটে।
দ্বিতীয়া শেষ- ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৪৪ মিনিটে।
ফোঁটা দেওয়ার শুভলগ্ন- ৬ নভেম্বর, শনিবার দুপুর ১টা ১০ মিনিট থেকে ৩টে ২১ মিনিট পর্যন্ত।
মোট সময়- ২ ঘণ্টা ১১ মিনিট।
কোন দিকে মুখ করে ফোঁটা নেবেন?
শাস্ত্র মতে, পূর্ব দিকে মুখ করে ফোঁটা নেওয়া শুভ। আবার উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করেও ফোঁটা নেওয়া যেতে পারে। তবে ভুলেও দক্ষিণ দিকে মুখ করে ফোঁটা নেবেন না। এই দিকটিকে অশুভ মনে করা হয়।
ফোঁটা দেওয়ার নিয়ম
শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে ভাইকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায় বোন। ভাইকে আসনে বসিয়ে শুরু হয় ফোঁটা দেওযার অনুষ্ঠান। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দূর্বা, বাড়িতে আমপাতায় পারা কাজল, চন্দন সাজিয়ে রাখা হয় ভাইয়ের সামনে। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ ও শঙ্খ। আর মুখ মিষ্টি করানোর জন্য থাকে ভাইয়ের পছন্দের সমস্ত মিষ্টিও। এর পর বোনেরা বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে এঁকে দেয় ভাইয়ের ভ্রু-যুগল। এবার ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার সময় ছড়া কাটে বোনেরা—
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।’ এই ছড়া কেটে কপালে তিন বার ফোঁটা দেওয়া হয়। চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার পর শঙ্খ ধ্বনির মাঝে ধান-দূর্বা দিয়ে ভাইকে আশীর্বাদ করে বোন। এবার মিষ্টিমুখ করার পালা। তার পর ভাই-বোনের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান করা হয়।
কবে ও কেন ভাই ফোঁটার প্রচলন শুরু হল, সে বিষয় পৌরাণিক কাহিনিতে উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কাহিনি অনুযায়ী—
সূর্য ও সংজ্ঞার সন্তান যম ও যমী বা যমুনা। যমুনা নিজের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন, তার পর থেকে এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে।
কথিত আছে, যমুনা নিজের ভাই যমকে একাধিক বার নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ধর্মরাজ যম নিজের বোনের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে যেতে পারতেন না। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাড়ির দ্বারে নিজের ভাই যমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান যমী। প্রসন্নতা ও স্নেহের সঙ্গে সেই তিথিতে নিজের ভাইকে ফোঁটা দেন ও ভোজন করান যমুনা। এর পর যম যমীকে বর চাইতে বলেন। তখন, যমী ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নেন যে, প্রতি বছর তিনি কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় যমীর বাড়িতে ভোজন গ্রহণ করতে আসবেন। পাশাপাশি এ-ও বর চান যে, এই তিথিতে যে বোন নিজের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ভোজন করাবে, তাঁর কখনও যমের ভয় থাকবে না। তার পর থেকেই ভাই ফোঁটার রীতি পালিত হয়ে আসছে।
আবার যমুনার জলে স্নান করলে নরক যাতনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলেও, মত প্রচলিত আছে। এমনও বর চেয়েছিলেন যমুনা। যম বোনের এই ইচ্ছাও পুরো করেন। কিন্তু পাশাপাশি সতর্ক করেন, যে ভাই নিজের বোনের তিরস্কার করবে ও অপমানিত করবে, তাঁকে যমপাশে বেঁধে যমপুরী নিয়ে যাবেন তিনি। তা সত্ত্বেও, ভাই যদি যমুনার জলে স্নান করে সূর্যকে অর্ঘ্য দেন, তা হলে স্বর্গলোকে তাঁর স্থান সুনিশ্চিত হবে। এদিন ভাই-বোনের যমুনায় স্নান করা শুভ মনে করা হয়। মৎস্য পুরাণ অনুযায়ী, মৃত্যুর দেবতা যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে ষোড়শোপচার বিধিতে পুজো করা উচিত।
আবার অন্য এক প্রচলিত পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নরকাসুর দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ গৃহে ফিরলে, বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বেলে, ফুল, ফল, মিষ্টি দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এর পর কৃষ্ণের কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা। পাশাপাশি কৃষ্ণের আরও সহস্র বছর বেঁচে থাকার কামনা করেন। মনে করা হয়, তখন থেকেই ভাই ফোঁটার সূচনা।
চনা।