উলুধ্বনি হল বাংলা-সহ, অসম, ওড়িশা, কেরালা ও তামিলনাডুর একটি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা। বিবাহ ও অন্যান্য উৎসবে মহিলারা মুখে ‘উলুলুলুলু’' ধ্বনি উচ্চারণ করেন। এটিকে উৎসব ও সমৃদ্ধির প্রতীক মনে করা হয়।
যে কোনও পুজো পার্বনেই ঢাক ঢোলের বাদ্য, শঙ্খনাদ, করতাল-মৃদঙ্গের বাদ্যের পাশাপাশি যে শব্দটি আমাদের কান জুড়ে থাকে, তা হল মহিলাদের সমবেত উলুধ্বনি। এটি সমগ্র পরিবেশে এক দৈবিক আবহ তৈরি করে যা দ্বারা দেবতারা সন্তুষ্ট হন বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি আশে পাশের পরিবেশ প্রকৃতিকেও সংশ্লিষ্ট যজ্ঞ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয় এই ধ্বনি। এই নাদকে সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়। তবে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সনাতন মতে এই উলুধ্বনির দুটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রথম ব্যাখ্যাটি হল উলুধ্বনি হল ওঁ কার ধ্বনি। ‘অ’-এ সৃষ্টি, ‘উ’-এ স্থিতি, ‘ম’-এ লয়। এই নাদধ্বনি ব্রহ্মতরঙ্গ অ, উ, ম-কে স্বরল হরিতে উচ্চারণ করেই উলুধ্বনি করা হয়। এই উলুধ্বনি মহাচৈতন্য শক্তির জাগরণ জয়ধ্বনি। তাই এই ওঁ-কার জয়ধ্বনি উলুধনি রূপে মাঙ্গলিক কাজে উচ্চারণ করা হয়।
ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যা একাধারে ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযোজ্য। এই বুৎপত্তি অনুযায়ী ওঁ-কার এমন এক শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, অজ্ঞাননাশক ও জ্ঞানপ্রদাতা। ওঁ তিনটি মাত্রাযুক্ত— ‘অ-কার’, ‘উ-কার’ ও ‘ম-কার’। এই তিনটি শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী যথাকরমে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং ধ্বংসকর্তা শিব। এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় যে হিন্দু সংস্কৃতিতে যে কোনও পূজা পার্বন বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এই তিন মহাশক্তিকে স্মরন করে বা আবাহন করে তবেই তা শুরু করা হয়। কারণ তাঁরাই এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মঙ্গলের বাহক।
এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বৈষ্ণবদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বৈষ্ণবমতে উলু শব্দটি মুলত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার হ্লাদিনী শক্তি রাধার নামের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে উ শব্দের অর্থ রাধা ও লু শব্দের অর্থ কৃষ্ণ। এই মতে, যে কোনও শুভ কাজ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি করার অর্থ হল, জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধারানিকে আবাহন করে সেই শুভ কর্মের সফলতা কামনা করা।