শরৎ কালে দুর্গাপুজো শুরু নিয়ে একাধিক ইতিহাস থাকলেও, তর্কাতীত নয় এবং জটিলও বটে। তবে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় যে তথ্যটি প্রচারিত, তা হল, রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গার অকালবোধন করেন। ঐতিহ্যগত ভাবে তার আগে বসন্তকালে দুর্গাপুজো হত।
অকালবোধন শব্দটি কৃত্তিবাসের রামায়ণে পাওয়া গেলেও, বাল্মিকী রামায়ণে এর কোনও উল্লেখ নেই। অকালে দুর্গাকে আহ্বান জানানো হয়েছিল বলেই, অকালবোধন বলা হয়ে থাকে।
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শেষ অংশ থেকে শুরু করে জুনের শেষাংশ অর্থাৎ বসন্ত বা উত্তরায়ণের সময়টি হল দেব-দেবী আরাধনার সবচেয়ে পবিত্র ও উপযুক্ত সময়। কারণ উত্তরায়ণের সময় দেব-দেবী জাগ্রত ও সক্রিয় থাকেন। উত্তরায়ণকে দেবতাদের দিন বা সময় বলা হয়। এ সময় দিন বড় ও রাত ছোট হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী চৈত্র মাসে দুর্গা আরাধনা নির্ধারিত। অন্যদিকে শরৎ বা দক্ষিনায়ণের সময়টি হল দেব-দেবীদের বিশ্রামের সময়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, দক্ষিনায়ণের সময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে ও উত্তর গোলার্ধে আগমন ঘটে শীতের। এ সময় দিন ছোট ও রাত বড় হয়। পুরাণ অনুযায়ী দক্ষিনায়ণের সময়টি আবার অসুরদের আধিপত্যের সময়। আর দুর্গাকে যেহেতু ভুল সময়ে আবাহন করা হয়েছিল, তাই এটি অকালবোধন নামে প্রচলিত।
অকালবোধন সম্পর্কে কৃত্তিবাসের রামায়নে উল্লেখ পাওয়া যায়— রাবণের বন্দিদশা থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে রাম বানরসেনার সাহায্যে লঙ্কা আক্রমণ করেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় রামকে প্রসন্ন করার জন্য রাবণ তাঁর প্রশংসা করে স্তোত্রপাঠ শুরু করেন। এর পরই দোটানায় পড়েন রাম। রাবণের এই বন্দনার ফলে রাম তাঁকে বধ করা থেকে বিরত হন। ফলে, দেব-দেবীও চিন্তিত হয়ে পড়েন। সে সময় রাবণের জিহ্বায় অধিষ্ঠিত হয়ে সরস্বতী রামের উদ্দেশ্য কটূক্তি করান। এর পরই রাম রাবণের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলেন ও রাবণকে দুভাগে ভাগ করে দেন। কিন্তু ব্রহ্মার আশীর্বাদে রাবণ পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধে সাহায্য চেয়ে অম্বিকার বন্দনা করেন। এর পরই অম্বিকা রাবণের রথে অধিষ্ঠিত হন।
অচিরেই রাম বুঝতে পারেন, দেবীর উপস্থিতিতে রাবণকে পরাজিত করা অসম্ভব। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর স্বর্গে চিন্তিত দেব-দেবীরা বিষ্ণুর দ্বারস্থ হন। তখন বিষ্ণুই চণ্ডী বা দুর্গা বন্দনার পরামর্শ দেন। তখন রাম চন্ডীর আরাধনা শুরু করেন। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট হন না দুর্গা। সে সময় বিভিষণ ১০৮টি নীলকমল সহযোগে দেবীবন্দনার পরামর্শ দেন রামকে।
![বিভিষণ ১০৮টি নীলকমল সহযোগে দেবীবন্দনার পরামর্শ দেন। বিভিষণ ১০৮টি নীলকমল সহযোগে দেবীবন্দনার পরামর্শ দেন।](https://images.hindustantimes.com/bangla/img/2020/10/21/original/blue_lotus_1603252234338.jpg)
রামের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই হনুমান দেবীদহা থেকে ১০৮টি নীলকমল এনে দেন। হনুমানের আনা ১০৮টি নীলকমল নিয়ে পুনরায় পুজো শুরু করেন রাম। কিন্তু পুজোর সময় ১০৭টি নীলকমল পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। পুজো সম্পন্ন করতে ও দুর্গার আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশে তীর-ধনুক দিয়ে নিজের এক চোখ উপড়ে দুর্গার চরণে অর্পণ করতে প্রস্তুত হন রাম।
![দুর্গার আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশে নিজের এক চোখ উপড়ে দুর্গার চরণে অর্পণ করতে প্রস্তুত হন রাম। দুর্গার আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশে নিজের এক চোখ উপড়ে দুর্গার চরণে অর্পণ করতে প্রস্তুত হন রাম।](https://images.hindustantimes.com/bangla/img/2020/10/21/original/durga01_1603252020708.jpg)
উল্লেখ্য, বিষ্ণুর মানবরূপ রাম নীল পদ্মসম চোখ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই একটি নীলকমলের পরিবর্তে রাম নিজের নীলকমল-সম চোখ দিতে উদ্বত হলেই, দুর্গা প্রকট হন। রামের আরাধনায় সন্তুষ্ট দুর্গা তখন রাবণের পক্ষ ত্যাগ করার আশীর্বাদ দেন।
আশ্বিন মাসের ষষ্ঠীর দিনে রাম এই পুজো শুরু করেছিলেন ও অষ্টমীর দিনে দুর্গা রামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর সামনে প্রকট হন। আবার অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দুর্গা রামের অস্ত্রে প্রবেশ করে রাবণবধের শক্তি জোগান। দশমীর দিনে রাবণবধ হয়। আবার এই সন্ধিক্ষণেই দুর্গার চামুণ্ডা স্বরূপ অসুর চণ্ড-মুণ্ডের সংহার করে।
![দশমীর দিনে রাবণবধ হয়। দশমীর দিনে রাবণবধ হয়।](https://images.hindustantimes.com/bangla/img/2020/10/21/original/ravana_1603252469453.jpg)
এই প্রচলিত ধারণা ছাড়াও, শরৎকালে দুর্গাপুজোর সূচনা সম্পর্কে অন্যান্য অভিমতও প্রচলিত রয়েছে। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুযায়ী, রাজা সুরাঠ নিজের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উদ্দেশে এক ঋষির পরামর্শে শরৎকালে দুর্গাপুজো করেন। আবার অন্য একটি ধারণা অনুযায়ী, মহিষাসুরবধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র দুর্গার অকালবোধন করেন। অন্য দিকে রামের আবাহনের ঠিক আগে ব্রহ্মাও একই উদ্দেশে অসময়ে দুর্গাকে আবাহন করেন। তবে দুর্গার এই অকালবোধনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ পৌরাণিক।