জৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার মা মঙ্গলচণ্ডীর আরাধনা করা হয়। তাই এই ব্রতের নাম মঙ্গলচণ্ডী পুজো। পুরা কালের কাহিনি অনুসারে ধনপতি সওদাগরের পত্নী খুল্লনা প্রথম দেবী মঙ্গলচণ্ডী মায়ের পুজো শুরু করেন। বলা হয় মায়ের শরণাগত হলে নির্ধন ব্যক্তি ধন প্রাপ্ত হন, অন্ধ ব্যক্তি চোখের জ্যোতি ফিরে পান, মেয়েরা সন্তান লাভ করেন। তাই সংসার জীবনে মা মঙ্গলময়ীর আরাধনা একান্ত প্রয়োজন।
মা মঙ্গলচণ্ডীর যে ছবির পট আমরা দেখতে পাই তাতে তিনি দ্বিভুজা। তার হাতে রয়েছে পদ্ম। তিনি পদ্মের উপরেই আসীন। মাতৃত্বের রূপ দেবীর মধ্যে প্রস্ফুটিত। ভবিষ্য পুরাণে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের উল্লেখ রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে মা মঙ্গলচণ্ডী কেবল স্ত্রীলোকের দ্বারাই পুজিত হন।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এই ব্রত পালন করতে হয়, পুরোহিত দ্বারা পুজো করে ব্রত কথা শ্রবণ করে এই ব্রত উদযাপিত করা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে অনেকেই এই পুজো করে থাকে।
এই ব্রতে ১৭টি গোটা সুপারি, ধান, দূর্বা, ফুল, ফল, বেলপাতা, পাকা আম, কাঁঠাল ইত্যাদি লাগে। মঙ্গলচণ্ডী পুজোয় কাঁঠাল পাতায় দূর্বা ঘাস, ধান, যব, মুগ কলাই রেখে খিলি বানিয়ে মা চণ্ডীকে প্রথমে নিবেদন করা হয়, পরে কলার মধ্যে সেই ধান যব পুরে গিলে খেতে হয়। এই দিন আমলা বাটা এবং হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয় প্রথমে মাকে। তারপর পাঁচ ফল দান করতে হয়।
মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত কথা
উজানীনগরে এক সওদাগরের বাড়িতে এক বুড়ি ব্রাহ্মণী প্রখর রোদে দুপুর বেলা ভিক্ষা চাইতে এসেছিল। সওদাগরের স্ত্রী তাকে ভিক্ষা দেয় চাল এবং টাকা। কিন্তু তার কোনও পুত্র নেই শুনে বুড়ি তার থেকে ভিক্ষা নেয় না। ভিক্ষা না নিয়ে চলে যাওয়ায় সংসারের অকল্যাণ হবে বলে সওদাগরের বউ কান্নায় ফেটে পড়লে তখন সওদাগর খোঁজ করে সেই বুড়ির কাছে যায়। বুড়ি তার হাতে একটা ফুল দিয়ে বলেছিল যে তার বউ যদি ফুল ধোয়া জল খায় তাহলে সে পুত্রের জননী হবে, সত্যিই তাই হয়েছিল এবং সেই ছেলের নাম রাখা হলো জয়দেব।
এবার সেই বুড়ি ব্রাহ্মণী আর এক সওদাগরের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল। পুত্র থাকলেও কন্যা সন্তান নেই তাই তিনি সেখানেও ভিক্ষা নিলেন না। ব্রাহ্মণী সেই সওদাগরের বউকে বললেন একটি ফুল দিয়ে সেই ফুল ধোওয়া জল খেতে, সেই ফুল ধোওয়া জল খাওয়ায় তারও একটি কন্যা সন্তান হল এবং তার নাম রাখা হলো জয়বতী।
জয়বতী এবং জয়দেব পাশাপাশি দু’টি গ্রামে বড় হতে থাকে। তারা একসঙ্গে খেলে বেড়ায়। জয়দেবের পুজো অর্চনায় অত ভক্তি নেই কিন্তু জয়াবতীর এ ব্যাপারে খুব বিশ্বাস ছিল। সে নিয়ম করে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করত। এর পরে জয়দেবের সঙ্গে জয়াবতীর বিয়ে হয়। জয়াবতিকে ব্রত পালন করতে দেখে জয়দেব জিজ্ঞেস করে যে সে কী ব্রত পালন করছে? জয়াবতী জানায় যে এই ব্রত পালন করলে নির্ধন ধন পায়, মরা মানুষ বেঁচে ওঠে হারালে ফিরে পায়, এ হল মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত।
জয়দেব শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় জয়াবতীর সমস্ত গয়না ডাকাতের ভয়ে একটা পুটলি করে নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল। জয়াবতীর বিশ্বাসকে পরীক্ষা করার জন্যই সে এটা করেছিল। এরপর শ্বশুরবাড়িতে বৌভাতের দিন অতিথি আপ্যায়নের সময় নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। এত বিশাল সেই মাছ যে কেউ সেই মাছ কাটতে পারছিল না। তখন ডাক পরে জয়াবতীর। সে মা মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করে বটি দিয়ে সেই মাছ কেটে ফেলে অনায়াসে। সেই মাছের পেট থেকে সেই গয়নার পুটুলি পাওয়া গেছিল যা জয়দেব জলে ফেলে দিয়েছিল। সেদিন থেকে জয়দেব দেবীর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছিল। এভাবেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতের মাহাত্ম্য।