বাঙ্গালীদের আচার অনুষ্ঠান গুলির মধ্যে লৌকিক আচার অনুষ্ঠান অন্যতম আগামীকাল জামাই ষষ্ঠী এই দিনটি অরণ্য ষষ্ঠী নামে পরিচিত। এই দিন লৌকিকাঁচার অনুসারে দেবী ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। বৈদিক শাস্ত্রে তার কোনও উল্লেখ না থাকলেও বাংলার ঘরে ঘরে কিন্তু ষষ্ঠী পুজো করা হয়ে থাকে জৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে। এই ষষ্ঠী অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠী নামে পরিচিত।
অরণ্য ষষ্ঠী পালনের পিছনে রয়েছে নানা লৌকিক আচার অনুষ্ঠান ও কাহিনী। এ দিন একদিকে যেমন জামাই বরণ করা হয়। তেমনি যাদের জামাই নেই তারাও কিন্তু এই ষষ্ঠী পালন থেকে বিরত থাকেন না। মা ষষ্ঠীর থানে সকলেই নিজেদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য পূজো দিয়ে থাকেন।
অরণ্য ষষ্ঠীতে যে উপকরণ গুলি প্রয়োজন হয় তা হল তাল পাতার পাখা, দুর্বা, ধান, মিষ্টি, সুপারি, করম চা যা পুজোতে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, ফুল, বেলপাতা, আম পল্লব, হলুদ দিয়ে রাঙানো সুতো ইত্যাদি।
এই প্রত্যেকটি উপকরণেরই কিন্তু বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। ফুল বেলপাতা আর হলুদ দিয়ে রাঙানো সুতো যখন শাশুড়িরা তাদের জামাইয়ের হাতে বেঁধে দেয়, তখন মনে মনে প্রার্থনা করে তোমার পরিবারের সঙ্গে যাতে আমার পরিবারের বন্ধন অটুট থাকে, আমার মেয়ের সঙ্গে যেন তোমার সম্পর্কর বন্ধন চিরকাল ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ থাকে। পাখা দিয়ে জামাইকে হাওয়া করার অর্থ হলো আপদ বিপদ যেন তার থেকে দূরে থাকে। তিনবার ষাট ষাট ষাট বলে পাখার বাতাস করা হয়। এই তিনবার ষাট ষাট ষাট বলার অর্থ হল তার দীর্ঘায়ু কামনা করা। ধান হলো সুখ-সমৃদ্ধির ও বহু সন্তানের প্রতীক। দূর্বা চিরসবুজ ও চির সতেজতার প্রতীক। মেয়ে যাতে শ্বশুরবাড়িতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে তাই এই রীতিনীতি পালন করা হয়। তার সঙ্গে থাকে মা ষষ্ঠীর কাছে মেয়ের জন্য সন্তান কামনার প্রার্থনা।
এইদিন পুজোর ডালিতে কাঁঠাল পাতার উপর পাঁচ সাত বা নয় রকমের ফল রাখা হয়। তার মধ্যে একটি ফল হতেই হবে করমচা। আর থাকে ১০৮ গাছা দূর্বা। ষষ্ঠী পুজো উপলক্ষে শাশুড়িরা স্নান করে ঘটে জল ভরে ঘটের উপর স্থাপন করেন আম পল্লব। তার সঙ্গে রাখেন তাল পাতার পাখা। ১০৮ টি দূর্বা দিয়ে বাঁধা আটি দিয়ে পুজোর উপকরণ সাজানো হয়। করমচা সহ ৫ অথবা ৭ থেকে ৯ রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার উপর সাজিয়ে রাখতে হয় শাশুড়িকে। তারপর সুতো হলুদে রাঙিয়ে তাতে ফুল বেল পাতা দিয়ে গিট বেঁধে দেওয়া হয় । এরপর মা ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। বাড়ির কাছে মা ষষ্ঠীর থান থাকলে সেখানে গিয়ে শাশুড়িরা এই পুজো দিয়ে আসেন। তারপর ব্রতকথা পাঠ করে পাখার বাতাস দিয়ে সন্তান ও জামাইকে বাতাস করে সকলের হাতে মা ষষ্ঠীর সুতো বেঁধে উপবাস ভঙ্গ করেন শাশুড়িরা। ঘটের জলে ভেজানো তাল পাতার পাখার বাতাস করা হয়। যাতে সমস্ত আপদ বিপদ দূরে যায়।
ব্রত কথা: এক পরিবারে দুই বউ ছিল। ছোট বউ ছিল খুব লোভী। বাড়ির মাছ বা অন্য কোনো ভালো খাবার রান্না হলে সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত যে, সব কালো বিড়ালে খেয়ে নিয়েছে। বিড়াল হল মা ষষ্ঠীর বাহন। তাই বিড়াল মাছ ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানালো, মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন। এরপর তার সাত পুত্র ও এক কন্যাকে একে একে মা ষষ্ঠী কেড়ে নিলেন। ফলে স্বামী শাশুড়ি ও অন্যান্যরা তাকে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। এদিকে সুখে ঘর করতে থাকে বড় বউ তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে।
ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যায় ও একাকী কাঁদতে থাকে। তাকে দেখে মা ষষ্ঠীর দয়া হয়। শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে তার কান্নার কারণ জানতে চান। সে তার দুঃখের কথা বলে, তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের জন্য তাকে বলে মা ষষ্ঠীর কাছে যেন সে ক্ষমা চায়। মা ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করবেন। এরপর বলেন যে, সে যেন নিষ্ঠা ভরে ষষ্ঠী পুজো করে, তাহলেই সে তার সাত পুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে। আশা নিয়ে সংসারে ফিরে আসে ছোট বউ। এরপর ঘটা করে নিষ্ঠা ভরে মা ষষ্ঠীর পুজো করে সে। একে একে ছোট বউ সাত পুত্র ও এক কন্যাকে ফিরে পায়। এরপর থেকেই মা ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই হলো জামাইষষ্ঠী বা অরন্য ষষ্ঠীর ব্রতকথা।
এবার জামাই ষষ্ঠী পড়েছে ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ (বাংলা ) ২৫ মে (ইংরেজি ) বৃহস্পতিবার। ষষ্ঠী তিথি শুরু হচ্ছে ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ রাত্রি ৩ টে ২৮ মিনিটে। ষষ্ঠী তিথি শেষ হচ্ছে ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, বিকেল ৫ টা ২৬ মিনিটে।