পয়লা বৈশাখ। একসময়ে এই দিনে চেনা-পরিচিত দোকানে ঢুঁ মারার রেওয়াজ ছিল। সন্ধ্যাবেলা গা ধুয়ে, পাউডার মেখে নতুন পাঞ্জাবিটা পরা। তারপর পাড়ার দর্জির দোকান, সোনার দোকানে যাওয়া। মাইকে বাজত 'বুম্বাদা'র সিনেমার কোনও গান। 'দাদা এসেছেন?' বলে হাসিমুখে হাতে সন্দেশ, খাস্তা কচুরির প্যাকেট ধরিয়ে দিতেন দোকানদার। সেই সঙ্গে রোল পাকিয়ে গার্ডার দিয়ে বাঁধা একটি নতুন বাংলা বছরের ক্যালেন্ডার। তাতে সাধারণত লক্ষ্মী-গণেশ, লোকনাথ বাবা, দুর্গার মতো ছবি থাকত। ছবির তলায় বা উপরে দোকানের নাম। সেই ক্যালেন্ডার, মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিতেন সন্তুষ্ট ক্রেতা। অনেকেরই ৪-৫টা ক্যালেন্ডার, প্যাকেট জমে যেত।
তবে সেই সব এখন অতীত। নতুন প্রজন্মের Subho Nabobarsho-র ভিড়ে বাংলা ক্যালেন্ডারের গুরুত্ব ওই একদিনই। ফলে বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে আর আলাদা করে মাথা ঘামান না কেউ-ই। গ্রাম-মফস্বলে আগের আমেজ থেকে গেলেও, শহুরে, নতুন ঝাঁ-চকচকে দোকানগুলিতে বদলে গিয়েছে রীতি-রেওয়াজ।
TOI-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে বাংলা ক্যালেন্ডারের চাহিদা আগের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। আর এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি প্রিন্ট-প্রেস ব্যবসায়ীরা। সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে মুক্তারম বাবু স্ট্রিটের এক প্রিন্ট ব্যবসায়ী পরিস্থিতির একটি ছবি তুলে ধরেন। 'প্রায় ৩০ বছর ধরে এই কাজে যুক্ত। চৌরঙ্গীর লক্ষ্মী নারায়ণ সেন জুয়েলারির দোকানে মহামারীর আগে প্রায় ২,০০০ ক্যালেন্ডারের অর্ডার পেতাম। এই বছর তারা মাত্র ৫০০টি ক্যালেন্ডার অর্ডার করেছে,' জানালেন তিনি। একই ছবি বউবাজার, চৌরঙ্গী, ভবানীপুর এবং গড়িয়াহাটের প্রায় ৭০টি দোকানের। আগের মতো আর কেউ-ই বাংলা ক্যালেন্ডারের অর্ডার দেন না।
মহামারীর সময়ে এমনিতেই অর্ডার কমে গিয়েছিল। বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আবার অর্ডার বাড়বে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু ক্যালেন্ডারের সেই আগের মতো আর চাহিদা নেই। ইংরাজি ক্যালেন্ডারই এখন বহু বাড়িতে থাকে না। ফোন, কম্পিউটার, স্মার্টওয়াচেই কাজ সারেন। সেখানে বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা ভাবা বিলাসিতা মাত্র।
TOI-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যানিং স্ট্রিটের পাইকারি বাজারে গত ২ বছরে অন্তত ৫টি ক্যালেন্ডারের দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন মোঃ মুর্শিদ আলম। প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি এই এলাকায় একটি ক্যালেন্ডারের দোকান চালাচ্ছেন। আলম বলেন, 'একটা সময় ছিল যখন বাংলা ক্যালেন্ডারই ছিল আমাদের রুজি-রুটি।'
অর্থনীতিও পাল্টে যাচ্ছে
শুধু বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রতিই মানুষের অনীহা, এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। আসলে বাজার অর্থনীতিও বদলে যাচ্ছে। শহর তো বটেই, পঞ্চায়েত, মফস্বল এলাকাতেও এখন More, রিলায়েন্স রিটেল, স্পেনসার্সের মতো দোকান। বিভিন্ন বড় গহনার দোকানও ছোট শহরগুলিতে তাদের আউটলেট খুলে ফেলেছে। ফলে মুদি দ্রব্য হোক বা সোনা, পাড়ার ওই নির্দিষ্ট একটি দোকানের প্রতি আর ক্রেতাদের আনুগত্য নেই। যেখানেই বেশি অপশন, ডিসকাউন্ট পান, সেখানেই চলে যান তাঁরা।
তাছাড়া সোনার দোকানেও আগের মতো মানুষ ঘন-ঘন যান না। আগে মধ্যবিত্ত পরিবারেও সন্তানের বিয়ে, কোনও অনুষ্ঠান বা নেহাত্ই শখের বশে অল্প অল্প করে টাকা দিয়ে সোনার জিনিস কেনার রেওয়াজ ছিল। তবে বর্তমানে সবার পকেটের যা অবস্থা, তাতে সোনা নিয়ে এমন বিলাসিতার আর যুগ নেই। টাকা থাকলেও ক্রেতারা দামি ফোন, ব্র্যান্ডেড ব্যাগ, ডিজাইনার পোশাক, বিদেশ ভ্রমণে খরচ করতেই বেশি পছন্দ করেন। নতুন প্রজন্মের সোনার গয়নার প্রতি আগ্রহ বেশ কম। আর ঠিক সেই কারণেই দোকানগুলিতে 'লয়াল' ক্রেতা তৈরি হচ্ছে না। ফলে আগের মতো সেই ক্যালেন্ডার, মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার রীতিও নেই।
এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup