করোনার থাবায় যে পেশাটি সব চেয়ে আগে ধসে পড়েছিল, সেটি হল পর্যটন শিল্প। দ্বিতীয় ঢেউয়েও সেই রেশ অব্যাহতই থাকল। বেঁচে থাকার ইদুর দৌড়ের বাঁধা ছক ভেঙে ক্ষণিকের শান্তি খুঁজতে বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘুরতে যান পর্যটকেরা। সেক্ষেত্রে পর্যটন শিল্পের কাঁধে ভর করেই যেতে হয় তাঁদের। আর ঠিক এই জায়গাতেই হানা দিয়েছে মারণ ভাইরাস। সারা দেশের মতো এরাজ্যেও বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছে পর্যটন শিল্প। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার কর্মীরা। এবার সুন্দরবনের পর্যটন ব্যাবসায়ও থাবা বসাল করোনা।
এরাজ্যে দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর থেকেই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে গোটা সুন্দরবন। ভ্রমণের জন্য আর কোনও পর্যটকই সেখানে যাচ্ছেন না বলেই দাবি পর্যটন ব্যবসায়ীদের। লঞ্চ বা নৌকোয় চড়ে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ঘুরে দেখাই সুন্দরবন ভ্রমণের মূল আকর্ষণ। সেখানেও বন্ধ হয়ে গিয়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। ফলে, কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার লঞ্চ ও নৌকোর মালিকেরা। কীভাবে কর্মীদের বেতন দেবেন, তাও বুঝতে পারছেন না কেউই।
পর্যটকদের লঞ্চ বা নৌকোয় করে সুন্দরবন যেতে হলে, হেমনগরের কালীতলার খেয়াঘাট থেকে নৌকোয় চড়তে হয়। গত দু’মাসে এক জন পর্যটকও খেয়াঘাটে আসেননি বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
কালীতলা টুরিস্ট বোট ইউনিয়নের সম্পাদক সামাদ গাজি বলেন, ‘ পর্যটকদের জন্য প্রায় ১৫০০ নৌকা চলত। প্রায় ছ’হাজার কর্মী কাজ করতেন। এই সময়ে নৌকা মালিকদের কমপক্ষে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা করে লাভ থাকত। এ বার তো এক পয়সাও আয় হচ্ছে না। উল্টে কর্মীরা এখন গ্রামেও কাজ পাচ্ছেন না। অন্য দিকে, সংক্রমণের ভয়ে বাইরেও যেতে পারছেন না তাঁরা।’
শুধু জলেই না, একই ছবি ধরা পড়েছে স্থলেও। সংক্রমণের আশঙ্কায় হোটেল, হোম—স্টে কিংবা লজগুলো থেকেও পর্যটকদের ভিড় উধাও হয়ে গিয়েছে। এমনকী, পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের হেমনগর থানার কালীতলা পঞ্চায়েত এলাকার ১২টি গেস্ট হাউস ও হোম-স্টেগুলোতে। এ ছাড়াও গোবিন্দকাটি, যোগেশগঞ্জ পঞ্চায়েত এলাকাতেও ব্যবসা মার খেয়েছে কয়েকটি গেস্ট হাউসের। প্রত্যেকেরই আর্থিক অবস্থা অত্যান্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেও একই সমস্যা। হোটেল কর্মীদের কীভাবে বেতন দেবেন বা ব্যবসার এই বিপুল ক্ষতি কীভাবে সামলাবেন, তা ঠাওর করতে পারছেন না কোনও হোটেল মালিকেরাই।
গোবিন্দকাটি এলাকার একটি ইকো-টুরিজম সেন্টারের মালিক পার্থ দাসের কথায়, ‘আগে এই সময় প্রায় অর্ধেক ঘর ভরতি থাকত। ঘর বুকিংয়ের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত পর্যটকদের মধ্যে। এখন সে সব অতীত। ভোটের সময় থেকেই কোনও পর্যটক আর আসছেন না। এরকম চলতে থাকলে, ব্যাবসার কি পরিণতি হবে, তা ভেবেই কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না হোটেল মালিকেরা।
কালীতলা বাজারের একটি গেস্ট হাউসের মালিক কুন্তল মণ্ডল বলেন, ‘ গত বছরের লকডাউনের ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারিনি। এর মধ্যেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এল। প্রায় দু’মাস পর্যটকরা এমুখো হননি। তলানিতে এসে ঠেকেছে আয়। আপাতত অর্ধেক বেতন দিচ্ছি কর্মীদের। কত দিন সেটা দিতে পারব, তাও জানি না।’
আবার সামসেরনগরের একটি গেস্ট হাউসের মালিক অজয় পাল বলেন, ‘গত বছর লকডাউনের সময় সুন্দরবনের মানুষের পাশে দাঁড়াতে কয়েকটি সংগঠন এসেছিল। তাঁরা এই গেস্ট হাউসে এসে উঠায় কিছুটা আয় হয়েছিল। তবে এবার অনেক দিন কেটে গেল, এখনও পর্যন্ত কেউ এলেন না। সেকারণে আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে গেস্ট হাউস বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তবে কর্মীদের মুখের দিকে চেয়ে তাঁদের বেতন দিতে হচ্ছে।’ তিনি জানান, কর্মীদের বেতনের জন্য মাসে খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অথচ, গত দু’মাস ধরে আয় কার্যত শূন্য।