কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর গত বুধবার দাবি করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার অধীনে প্রায় ১.২ কোটি 'অবৈধ ভোটারদের' ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে। তাঁর এই বক্তব্য ঘিরে বঙ্গে রাজনৈতিক তরজা তুঙ্গে। শান্তনুর দাবির পরই তৃণমূল কংগ্রেস হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে এই পদক্ষেপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে মতুয়া শরণার্থী সম্প্রদায়।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের আশঙ্কা খারিজ করে দিয়ে বলেছে যে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ নিবিড় সংশোধনের সময় কোনও বৈধ ভোটারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাটে ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে এই কথা জানান রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ কুমার আগরওয়াল। বৈঠকে ডেপুটি ইলেকশন কমিশনার জ্ঞানেশ ভারতী সহ চার সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল এসআইআর-এর প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন। এই আবহে মনোজ কুমার আগরওয়াল বলেন, 'কোনও বৈধ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে না। আইনে যা বলা হয়েছে, তা অনুসরণ করা হবে। যাদের নাম ২০০২ সালের এসআইআর-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং যারা সরকারি কর্মকর্তা তাদের কোনও নথি জমা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
এর আগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটায় অনুষ্ঠিত বিজয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শান্তনু ঠাকুর বলেন যে এসআইআর ভোটার তালিকাকে স্বচ্ছ করবে এবং 'রোহিঙ্গা, অনুপ্রবেশকারী এবং ভুয়া ভোটারদের' সরিয়ে দেবে। শান্তনু ঠাকুর বলেন, 'যদি এসআইআর সঠিকভাবে কার্যকর করা হয়, তবে তৃণমূল সরকারের কাছে পালানোর কোনও পথ থাকবে না। ভোটার তালিকায় অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত কমপক্ষে ১ থেকে ১.২ কোটি লোককে অপসারণ করা হবে। রোহিঙ্গা, অনুপ্রবেশকারী ও ভুয়া ভোটাররা আর ভোট দিতে পারবে না।' তিনি বলেন, একটি 'পরিচ্ছন্ন' ভোটার তালিকা বাংলায় সত্যিকারের পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে। মন্ত্রী বলেন, 'যারা সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন চান, যারা রাজ্যে শিল্প, শিক্ষা ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা চান, তাঁরা ভোট দেবেন।' পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শান্তনু ঠাকুর বলেন, সংশোধিত ভোটার তালিকা স্বচ্ছতা আনবে এবং কতজন রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি ও ভুয়া ভোটারকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কতজন শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরিষ্কার হবে। তিনি বলেন, 'শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে না। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তারা আবার বৈধ ভোটার হবেন।'
এদিকে এই তরজার মাঝেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেছেন যে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের 'হুমকি' দিচ্ছেন এবং বিধানসভা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই 'রাজনৈতিক প্রভাবে কাজ করছেন'। ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনের (এসআইআর) নামে ভারতীয় জনতা পার্টি আগুন নিয়ে খেলা করছে বলে অভিযোগ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে ভোটার তালিকা হস্তক্ষেপের যে কোনও প্রচেষ্টা গণতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। পশ্চিমবঙ্গ সচিবালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের হুমকি দিচ্ছে। আমরা এটা সহ্য করব না।' তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, ভোটের তারিখ ঘোষণার আগে রাজ্যে সফররত নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা কীভাবে সরকারি আধিকারিকদের তলব করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ আগরওয়ালকে ইঙ্গিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন যে রাজ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া তদারকি করা নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে 'অনেক অভিযোগ' রয়েছে। মমতা বলেন, 'তিনি নিজেও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত এবং এসআইআর-এর অজুহাতে ভোট কাটার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমার কাছে প্রমাণ আছে। আশা করি, তিনি দেশ ও গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। এই এসআইআর আসলে তেমন নয়। পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস)-এর মতো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য এটি একটি পর্দা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এদিকে তৃণমূল সাংসদ তথা মতুয়া নেতা মমতাবালা ঠাকুর আবার বলেন, 'মতুয়া শরণার্থীরা এসআইআরের জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন তারা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন। তৃণমূলের কোনও ক্ষতি হবে না, বরং আমাদের আসন বাড়বে।' মমতাবালা ঠাকুর অভিযোগ করেছেন যে বিজেপি নেতৃত্ব ভোটার এবং শরণার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। তিনি বলেন, বিজেপি নেতৃত্ব এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা আসলে কী চায়। তারা জনগণকে, বিশেষ করে শরণার্থীদের সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্ত করেছে।