অতীতের কথা তিনি ভোলেননি। তাঁর মনে আছে দাদার (ধীরেন কুমার বসাক) হাত ধরে ট্রেনে করে কলকাতায় আসার কথা। আর তা রোজই আসতে হত—বাড়ির দরজায় দরজায় শাড়ি বিক্রি করার জন্য। তা সে সত্তরের দশকের কথা। হ্যাঁ, আজ তাঁর নাম আলোকিত হচ্ছে। কারণ পদ্ম সম্মান প্রাপকের তালিকায় রয়েছেন শান্তিপুরের তাঁতশিল্পী বীরেনকুমার বসাক। যিনি এক টাকা দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। আর আজ বছরে ২৫ কোটি টাকার টার্নওভার।
জীবনের শুরুতে কষ্টটা ছিল কঠিন থেকে কঠিনতম। কিন্তু নিজের উপর ভরসা ছিল। তাই পথটা সোজা রেখে এগিয়েছিলেন তিনি। দাদার হাত ধরে শহরের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ঘুরেছিলেন শাড়ি বিক্রি করার জন্য। আজ সেই কষ্টেরই যেন মূল্যায়ন হল। এখন তাঁর মূল লক্ষ্য গ্রামীণ উন্নয়ন ঘটানো। আজ অবশ্য তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ৫,০০০ তাঁতশিল্পী। পদ্ম পুরস্কারে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘রোজ লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতাম। আমি এবং আমার দাদা রাস্তায় রাস্তায় শাড়ি ভরতি ব্যাগ নিয়ে দরজায় দরজায় কড়া নাড়তাম। এরকম করতে করতেই একটা বড় ক্রেতার তালিকা তৈরি হয়। তখন ১৫ থেকে ২৫ টাকা দাম ছিল শাড়ির।’
প্রতি বছরই প্রজাতন্ত্র দিবসের সময় পদ্মভূষণ–পদ্মবিভূষণ পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২১ সালের পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপকদের তালিকায় শান্তিপুরের তাঁতশিল্পী বীরেনকুমার বসাকের নাম উঠে আসে। তাতে তিনি আনন্দিত হয়ে বলেন, ‘আমি অত্যন্ত খুশি এবং এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমার কাছে এই পুরস্কার কঠোর পরিশ্রমের একটা স্বীকৃতি। আমার শিল্পীরা ৪৮ বছর ধরে এই কাজ করে চলেছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। রামায়ণের যুগের শাড়ি তৈরি করায় তিনি সাম্মানিক ডক্টরেট লাভ করেছিলেন। সবচেয়ে বন শাড়ি তৈরি করার জন্য তাঁর নাম গিনিস বুকেও উঠেছিল। ফুলিয়া এবং শান্তিপুর মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষ তাঁতশিল্পী আছেন। সেখানে তৈরি হয় জামদানি, টাঙ্গাইল, সিল্ক, তসর, মটকা, মুগা শাড়ি। এই পুরস্কার শুধু আমার একার নয়। এই পুরষ্কার তাঁর শিল্পীদেরও বলে জানান।
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে ৫,০০০ তাঁতশিল্পী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২,০০০ মহিলা। তাঁরা এখানে কাজ করে আজ স্বনির্ভর। এই পুরস্কার আসলে তাঁদেরই। ষাটের দশকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে হয়েছিল। পড়াশোনাও খুব একটা হয়নি। ১৩ বছর বয়স থেকে তাঁতশিল্পী হিসাবে কাজ শুরু করি। তখন দৈনিক আয় ছিল আড়াই টাকা।’ আজ তাঁর কাছ থেকে শাড়ি কেনেন স্বয়ং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর। অতীতে সত্যজিৎ রায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও তাঁর ক্রেতা ছিলেন।
বীরেনবাবু মসলিনের উপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি করেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে দেশে গিয়ে তিনি সেই শাড়ি তুলে দেবেন। এর আগে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রতিকৃতিও ফুটিয়ে তুলেছিলেন মসলিনের ওপর। তাঁর উপহার পেয়ে তারিফ করেছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। মসলিনের কাপড়ে দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পীর বাড়ি ফুলিয়ার চটকাতলায়।