মোটামুটি ছ'মাসের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গে উপকূলে দুটি ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছে - বুলবুল এবং আমফান। বুলবুল সেভাবে প্রভাব না ফেললেও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সুপার সাইক্লোন। তার জেরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজ কাঁকড়া বা হর্সশ্যু ক্র্যাবের বসবাসের জায়গা। লাখ লাখ বছর ধরে অপরিবর্তিত থাকায় সেটি ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ হিসেবে পরিচিত।
বন আধিকারিক এবং গবেষকরা আপাতত রাজ কাঁকড়ার স্বাভাবিক বাসস্থান ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং প্রজাতিকে রক্ষা করতে সুন্দরবনের তিনটি নতুন দ্বীপে তাদের ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন। পাশাপাশি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে রাজ কাঁকড়ার গতিবিধিতে নজর রাখার পরিকল্পনাও চলছে। বিষয়টি নিয়ে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের যুগ্ম অধিকর্তা এস কুলানদিভেল বলেন, ‘আমফান এবং বুলবুল ঘূর্ণিঝড়ের জেরে সাগরদ্বীপের রাজ কাঁকড়া ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা কলশ, হ্যালিডে এবং বকখালির সমুদ্রতটকে চিহ্নিত করেছি যেখানে কয়েকটি রাজ কাঁকড়া ছাড়া হবে।’
শুধু দীর্ঘদিন ধরেই অস্তিত্ব টিকে আছে বলে নয়, রাজ কাঁকড়ার বিভিন্ন গুণাগুণ রয়েছে।প্রতিষেধকে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি আছে কিনা জানতে বিভিন্ন ওষুধ সংস্থাগুলি রাজ কাঁকড়ার রক্তের উপর নির্ভর করে। ব্যাকটেরিয়ার এন্ডোটক্সিনের উপস্থিতিতে প্রাণীটির তামা-সমৃদ্ধ রক্ত জমাট বেঁধে যায়। যে এন্ডোটক্সিনের উপস্থিতি সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। সেজন্য দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাকটেরিয়াজনিত দূষণও শনাক্তকরণের জন্য প্রাণীটির রক্ত ব্যবহৃত হয়।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উলটোদিক থেকে ঘোড়ার নালের মতো দেখতে হওয়ায় প্রাণীটির এরকম নামকরণ হয়েছে। তবে কাঁকড়া হিসেবে পরিচিত হলেও রাজ কাঁকড়ার শারীরিক গঠন এবং কাজকর্ম পর্যালোচনা ভিন্ন। এই প্রাণী আদতে কাঁকড়া প্রজাতির নয় বলে মত বিজ্ঞানীদের। সারাবিশ্বে চার প্রজাতির রাজ কাঁকড়া বা হর্সশ্যু ক্র্যাব পাওয়া যায়। তার মধ্য়ে দুটি প্রজাতি ভারতে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ এবং ওড়িশার ভিতরকণিকার সমুদ্রতটের মোটামুটি ১৫০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই তাদের বাসস্থান সীমাবদ্ধ ।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইসার) সেন্টার ফর ক্লাইমেট এবং এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের প্রধান পুণ্যশ্লোক ভাদুড়ি বলেন, ‘মূলত বর্ষার সময় প্রজননের জন্য শয়ে শয়ে ভারতীয় হর্সশ্যু ক্র্যাব (Tachypleus gigas) সমুদ্রতটে আসে। অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ হর্সশ্যু ক্র্যাব (Carcinoscorpius rotundicauda) খাবারের জন্য সাধারণত ম্যানগ্রোভে থাকে।’
আর সাগরদ্বীপের সেই ম্যানগ্রোভ রাজ কাঁকড়াগুলির বাসস্থানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইসারের বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, ‘উপগ্রহ চিত্রে পরিষ্কারভাবে দেখা গিয়েছে যে সাগরদ্বীপে ম্যানগ্রোভ এলাকায় সেগুলির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওখানের খবর অনুযায়ী, ঝড়ে উড়ে আসা প্লাস্টিক-সহ বিভিন্ন নোংরা, ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া অনেকে ভূতুড়ে জাল রয়েছে। তা আদতে মাছের জাল। কিন্তু ঝড়ে ছিঁড়ে যাওয়ায় তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।’
যাবতীয় ধ্বংসস্তূপ এবং জাল সরিয়ে শীঘ্রই রাজ কাঁকড়ার বাসস্থান ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করবেন বন আধিকারিক, আইসার এবং ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার গবেষকরা। আমফানের কারণে জীবিকায় টান পড়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবীদেরও সেই কাজে যুক্ত করা হবে। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজ কাঁকড়াকে সাগরে রাখা হবে। আহত রাজ কাঁকড়াদেরও খোঁজ করা হবে এবং চিকিৎসার পর তাদের নিজেদের স্বাভাবিক বাসস্থানে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই বাসস্থানকেও ভবিষ্যতে ইকোলজিকাল সেনসিটিভ জোন হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়েও কথাবার্তা চলছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার এগজিকিউটিভ ট্রাস্টি বি সি চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রথমে ক্ষতির মূল্যায়ন করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের থেকেও বেশি জলোচ্ছ্বাস এবং প্রবল বৃষ্টির কারণে ম্যানগ্রোভ এবং কাদামাটির বাসস্থান বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কয়েকটি রাজকাঁকড়া জলে ভেসে স্থলের আরও ভিতরে ঢুকে যেতে পারে এবং তাদের লেজ ভেঙে যেতে পারে।’