ঘটনা ১: ২০২৪-এর ২৪ এপ্রিল। প্রমোদনগর থেকে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠছিল একটি ট্রলার। দ্রুতগতিতে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে চলা লরি সেই ট্রলার দেখে ব্রেক কষে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পিছন থেকে একই বেগে আসছিল আরেকটি লরি। সেটি সামনের লরিকে ধাক্কা মারে। পাশের ডিভাইডারে উঠে যায় দুটি লরি। দুর্ঘটনার শিকার হন এক খালাসি।
ঘটনা ২: ২০২৫-এর ২৪ জানুয়ারি। বেলঘরিয়া হাইওয়ের উপর ঢালাই কারখানার কাছে এয়ারপোর্টগামী অ্যাপ ক্যাবকে পিছন থেকে ধাক্কা মারে বালি ভর্তি লরি। দুমড়েমুচড়ে যায় ক্যাবটি। ভিতরে থাকা দুই যাত্রীসহ চালক গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন।
ঘটনা ৩: ২০২৫-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেনটাইনস ডে উপলক্ষে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছিলেন বরানগরের বাসিন্দা বছরের উনিশের সায়ন্তন সরকার। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সতীন সেন নগরের কাছে দুই লরির রেষারেষির মাঝে পড়ে মৃত্যু হয় যুবকের। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে গোলাপ।
ঘটনা ৪: ২০২৫-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি। স্কুটিতে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন জয়দীপ। এয়ারপোর্ট তিন নম্বর গেটের কাছে একটি লরি পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা মারে। পিষে দেয় তিনজনকেই। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ। বারাসত হাসপাতালে আহতদের নিয়ে গেলে তিনজনকেই মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

‘কালেকশন করতে বিজি’
শুধু বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের প্রসঙ্গ টানলে এরকম আরও ঘটনার উল্লেখ করা সম্ভব। বাস থেকে দুই চাকা, সবরকম গাড়িই আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াত করে। অথচ প্রতিটি ঘটনাতেই ভিলেন লরি। বারবার প্রাণহানি হয় তাদের বেপরোয়া গতির জেরে। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যাদের থাকার কথা, সেই ট্রাফিক পুলিশ কোথায়? স্থানীয়দের অভিযোগ, অর্ধেক সময় পুলিশকে সিগনালে দেখা যায় না। শুধু লরির বেপরোয়া গতি এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নয়। পুলিশদের তরফেও যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। রবিবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পীযূষ ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘পুলিশের গাড়ি এখানে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ সময় লরিচালকদের থেকে কালেকশন করতে ব্যস্ত থাকে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনও হুঁশ নেই। কন্ট্রোল রুমে মাঝে মাঝে সিভিক ভলান্টিয়ার থাকলেও চোখ সর্বক্ষণ ফোনে!’
আরও পড়ুন - হার্টের রোগীদের বাদাম খাওয়া কতটা ভালো? HT বাংলায় আলোচনা করলেন চিকিৎসক

‘বাবুদের খুশি করতে হয়’
এদিন যে হোটেলের সামনে দুর্ঘটনাটি ঘটে, সেখানের এক কর্মচারীর কথায়, ‘যশোর রোড আর বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের কানেক্টর ভীষণ দুর্ঘটনাপ্রবণ। কিন্তু এখানে কোনও ট্রাফিক গার্ড দেখা যায় না। অধিকাংশ সময় ফাঁকা থাকে কন্ট্রোল রুম। এখন অ্যাক্সিডেন্টের পর একজনকে মোতায়েন করেছে পুলিশ। নয়তো এই একজনকেও দেখা যায় না।’ অফিসফেরত আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সুমিত বিশ্বাস জানাচ্ছেন, ‘বেলঘরিয়া হাইওয়েতে ঢুকলেই লরিগুলোর তাড়া লেগে যায়। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। গোটা রাস্তায় ২-৩ জায়গায় তোলা দিতে দিতে যেতে হয় তো! সেই ঝামেলা এড়াতে স্পিড বাড়িয়ে যেতে গিয়েই অ্যাক্সিডেন্ট করে।’ রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে থাকা একাাধিক লরিচালকদের মুখেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ। বারাসতমুখী এক লরিচালকের কথায়, ‘এই রুটে ঢুকলেই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা গচ্চা আছে। বাবুদের খুশি করতে হয়।’ ‘বাবুদের খুশি’ করার এত তোড়জোড়? কোনও নিষিদ্ধ বস্তু বহন করার জন্যই তোষামোদ করতে হয়? প্রশ্ন থেকে যায়।
আরও পড়ুন - ‘তোমার মতো যদি কারচুপি করতে পারতাম প্রতুলদা…’ তোমার জন্য আজও গান গাওয়ার সাহস পাই

পুলিশের যা বক্তব্য
এয়ারপোর্ট থানার ইনস্পেক্টর ইন-চার্জ অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘অভিযোগ এখন অনেককিছুই করবে, করলেই তার ভিত্তি থাকবে এমন নয়। পিডব্লুডি রাস্তা ছোট করে দেওয়ায় এখন ওদের অনেকরকম সমস্যা হচ্ছে। মানুষ তো শর্টকাটে যাতায়াতের জন্য বাউন্ডারি ক্রস করে যান। সেটাও তো ঠিক নয়। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৭০০ মিটার রাস্তা শুধু আমাদের। বাকিটা অন্য জেলা অন্য থানা।’ যদিও, দুর্ঘটনার এলাকাটি এয়ারপোর্ট থানার অধীনেই।

‘অন্য থানা’র দায়…
গত কয়েক বছর ধরেই বেশ ব্যস্ত রাস্তা হয়ে উঠেছে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। একদিকে দক্ষিণেশ্বর, অন্যদিকে এয়ারপোর্ট। সম্প্রতি সার্ভিস লেন তৈরি হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের দুই ধারে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্তির কাজও প্রায় শেষের মুখে। কিন্তু এই দীর্ঘ আট কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের তিন-চার জায়গায় শুধু সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়া আর কোনও ট্রাফিক গার্ড দেখা যায় না। সিগনালও ওই তিন-চারজায়গায়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি এক্সপ্রেসওয়ের ট্রাফিক নিরাপত্তার বিষয়ে কি অবহেলা থেকে যাচ্ছে? কেনই বা এত দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে? আর কেনই বা প্রতিক্ষেত্রে লরিই ভিলেন? এই প্রসঙ্গে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের এসিপি ট্রাফিক জয়ন্ত দাস হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে বলেন, ‘বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের বেশ কিছুটা ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে রয়েছে। তবে সিগনালে আমাদের ট্রাফিক গার্ড নিযুক্ত থাকে। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে।’ ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এসিপি ট্রাফিক অবশ্য এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। অন্যদিকে ব্যারাকপুরেরই ডিসিপি ট্রাফিক অতুল ভি গোটা ঘটনাটি শোনার পর ‘শুনতে পাচ্ছি না’ বলে ফোন কেটে দেন। পরে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।