প্রমোদ গিরি
গত ৩০ মার্চ রাজ্যে করোনায় দ্বিতীয় মৃত্যু হয়েছিল কালিম্পংয়ের এক মহিলার। ৪৪ বছর বয়সী সেই মহিলার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের ১০ জনের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসার পর আজ তারা সবাই সুস্থ। তবু পাহাড় ও সমতলের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখনো অচ্ছুৎ কালিম্পংয়ের বাসিন্দারা। নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাঁরা।
কালিম্পং জেলার বাসিন্দাদের হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না বা অ্যাম্বুল্যান্স পাচ্ছেন না বলে একের পর এক অভিযোগ উঠেছে। এর জেরে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি পরিবারের। লক্ষ্মী ঘাতানি নামে ৭০ বছরের ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করতে নাভিশ্বাস ওঠে পরিজনদের।
মংপোর বাসিন্দা ওই বৃদ্ধা গত শনিবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন তাঁর পরিজনরা তাঁকে রাম্বি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে কালিম্পং জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স দিতে অস্বীকার করেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকরা। অনেক জোরাজুরির পর অ্যাম্বুল্যান্স করে ওই বৃদ্ধাকে চিত্রে পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়। তার পর এক সমাজকর্মীর গাড়িতে হাসপাতালে পৌঁছন লক্ষ্মীদেবী। রবিবার বেলা ১টায় তাঁকে কালিম্পং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত ৮টায় মৃত্যু হয় তাঁর।
মৃতার ছেলে বিমল ঘাতানি বলেন, ‘মা কে সময়মতো কালিম্পংয়ে নিয়ে আসতে পারলে হয়তো মা বেঁচে যেত। অ্যাম্বুল্যান্স খুঁজতেই অনেকটা সময় কেটে গেল।’ সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, মংপোয় তাঁর মায়ের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছলে স্থানীয়রা তাঁকে ফোনে জানিয়েছেন, গ্রামে ফেরা চলবে না তাঁর। ১৪ দিন থাকতে হবে কোয়ারেন্টাইনে।
একই অভিজ্ঞতা কালিম্পংয়ের তিরপাইয়ের বাসিন্দা ইয়াসাকা ক্ষেত্রীর। গত ১৫ এপ্রিল আট বছরের ছেলে দিশানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। নিউমোনিয়ায় ভুগছিল দিশান। চিকিৎসক তাঁকে শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তৈরি করোনা চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন।
পেশায় গাড়ির চাল ইয়াসাকা ক্ষেত্রীর অভিযোগ, এই পরিস্থিতিতে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও চালক তাঁর কাছে ১,৫০০ টাকা দাবি করেন। এর পর নিজের গাড়িতেই ছেলেকে শিলিগুড়ি নিয়ে আসেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ, শিলিগুড়ির ওই নার্সিংহোম দিশানকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। তাঁদের উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যেতে বলা হয়। সেখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ভর্তির ব্যবস্থা হয়। সেই ব্যবস্থাতেও সন্তুষ্ট নন ইয়াসাকা বাবু। ১৬ এপ্রিল দিশানকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। সে এখন দিব্যি রয়েছে বলে জানিয়েছে তার বাবা।
গত সপ্তাহে হাসপাতাল নিয়ে এমন ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে কালিম্পংয়ের আলগড়ের বাসিন্দা সুজাতা শেরপার। তাঁকে আল্ট্রাসনোগ্রাফের জন্য শিলিগুড়ির হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন স্থানীয় চিকিৎসকরা। স্বামী সাঙ্গে শেরপাকে নিয়ে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে যান সুজাতা। অভিয়োগ, সেখানে তাঁরা কালিম্পং থেকে এসেছেন শুনেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হাবভাব বদলে যায়। সেখান থেকে তাঁদের উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সুজাতা দেবীর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সেকতা জানালেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরদিন তাঁদের পের হাসপাতালে আসতে বলা হয়। সেই রাত শিলিগুড়ির একটি গির্জায় কাটান দম্পতি। পরদিন USG করার পর এক সমাজসেবীর উদ্যোগে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।
লক্ষ্মী দেবীর ঘটনায় রাম্বি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার সিকে ছেত্রী জানিয়েছেন, ঘাতানি পরিবার হাসপাতালের কাছে কখনও অ্যাম্বুল্যান্স চায়নি। ওদিকে জ্যোতি কারকি নামে যে সমাজসেবীর গাড়িতে লক্ষ্মীদেবী কালিম্পং হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন তিনি জানিয়েছেন, কালিম্পংয়ের মানুষ মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।