বছর ঘুরলেই বিধানসভা নির্বাচন বাংলায়। তাই বিদ্রোহীদের বাদ দিয়েই ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত পদক্ষেপ করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাবরের অভ্যেস। যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ঠান্ডা মাথায় তিনি কাজ করতে সক্ষম। তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে শুভেন্দু অধিকারীর পদত্যাগ নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা। কিন্তু তাঁকে আমল দিতে আর রাজিই নন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। বরং শুভেন্দু পর্বে পুরোপুরি ইতি টেনে শুভেন্দুহীন দলের একুশের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলেন। সাংগঠনিক দায়িত্ববৃদ্ধি করলেন দলের শীর্ষ নেতাদের। একইসঙ্গে পুরোদমে ভোটপ্রচারে নামলেন তিনি নিজেও।
এরপরই দাদার অনুগামীদের কপালে এবার দুঃখ নামিয়ে আনলেন দিদিমণি। শুভেন্দু অনুগামী হিসেবে পরিচিত অমূল্য মাইতিকে জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। সুতরাং আর কোনও অজুহাত শুনতে যে মুখ্যমন্ত্রী রাজি নন তা এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল।
সূত্রের খবর, মঙ্গলবার মেদিনীপুর ছাড়ার আগে জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিং হাজরা এবং সহ–সভাধিপতি তথা দলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতিকে, অমূল্য মাইতিকে কর্মাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তিনি। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে এবার মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারকে বাদ দিয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তৃণমূল।
উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগেই অমূল্য মাইতির নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। শিশির অধিকারী এখনও দলের সাংসদ থাকলেও দলীয় ক্ষমতা থেকে তাঁকে সাইড করে দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্য তাঁর ছেলের জন্যই তাঁকে হতে হয়েছে। আবার মাঠে নেমে প্রচারের কাজটা আগেও যেমন করতেন, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও সেই একইভাবে করতে শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই শুভেন্দু গড়ে সভা করেছেন।
একুশের বিধানসভা লড়াই কিছুটা কঠিন শাসকদলের কাছে, তা বুঝেই এবার রণকৌশল চূড়ান্ত করলেন তিনি। শুক্রবার নিজের বাড়িতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জরুরি বৈঠকে ডেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। প্রশাসনের পাশাপাশি দল কীভাবে এগোবে, তাও ঠিক করে দেন মমতা। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সির মতো শীর্ষ নেতাদের সংগঠনের কাজে আরও বেশি করে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন। ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিও নির্দেশ দিলেন তিনি।
অমূল্য মাইতিকে সরিয়ে পরোক্ষভাবে শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামীদের কড়া বার্তা দিয়েছেন তিনি। তবে এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি অমূল্য মাইতির পক্ষ থেকে। দলকে নির্দেশ দিয়ে এবার নিজের কাজ করতে শুরু করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। একুশের বিধানসভা ভোটে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে মতুয়া ভোট। ঘর গোছাতে তাই আজ উত্তর ২৪ পরগনায় বনগাঁর গোপালনগর হাইস্কুলের মাঠে সভা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ কেন্দ্রে পরাজিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস। ৭টির মধ্যে ৬টি বিধানসভা কেন্দ্রেই পিছিয়ে ছিল তাঁরা। এবার এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নন দলনেত্রী। অন্য সময় শুভেন্দুকে পাঠিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতেন মুখ্যমন্ত্রী। এখন শুভেন্দুকে লস্ট কেস ধরে নিয়ে নিজেই ঝাঁপালেন নেত্রী।
সূত্রের খবর, শুভেন্দুকে যে যে জেলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবার সেখানে নিজে গিয়ে সংগঠন দেখে নেবেন তিনি। তাই এই জেলা সফর। প্রতিটি জেলায় যাবেন তিনি। সেখানের হাল–হকিকত দেখবেন। আর জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করবেন নির্বাচনে কারা পেছন থেকে ছুরি মারবেন আর কারা সত্যি দলের জন্য কাজ করবেন। তারপর একে একে তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে। বিশেষ করে নজর রাখা হচ্ছে শুভেন্দু অনুগামীদের উপর। যারা দাদার অনুগামী বলে পোস্টার–ব্যানার লাগিয়েছিল।
রাজ্যে মতুয়া গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কোচবিহার, মালদার একাংশ মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় ৭৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এইসব জেলায় শুভেন্দুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এবার নিজের কাঁধে তা তুলে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের সংগঠনের দায়িত্ব আবার তিনি দিয়েছেন সুব্রত বক্সির উপর। জেলায় জেলায় অন্য যাঁদের যা দায়িত্ব ছিল, সেইমতো কাজ চলবে এখন। মালদহে দীর্ঘদিন দলের পর্যবেক্ষক ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই মালদহে তৃণমূলের কোর কমিটিকে জরুরি তলব করা হয়েছিল কলকাতায়। মালদহ জেলা পরিষদের সভাধিপতি গৌরচন্দ্র মণ্ডল এবং জেলার দুই প্রাক্তন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র ও কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরিকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে প্রতিটি আসন যাতে তৃণমূল পায় তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে খবর। আর ২০২১ সালে যদি ফের তৃণমূল ক্ষমতায় আসেব, তা হলে বুঝতে হবে মমতার ক্যারিশমাই কাজ করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।