অভিযোগ দুর্নীতির। আর সেটা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না তৃণমূল কংগ্রেস। সেটা নিজের দলেরই সদস্য হোক বা বিরোধী দলের সদস্য। এটাই এখন দলীয় লাইন। তাই নানা আর্থিক অভিযোগে এক প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর, একজন পঞ্চায়েত প্রধান এবং পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন এক সভাপতি একইদিনে গ্রেফতার হলেন। এই ঘটনা দিয়ে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া হল, দলে যতই প্রভাবশালী হোন, কাউকেই রেয়াত করা হবে না দুর্নীতির প্রশ্নে। পুলিশ সঠিক পদক্ষেপ করলে অভিযুক্ত নেতার পাশে থাকবে না তৃণমূল কংগ্রেস। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হলদিয়া এবং কাঁথির জনসভায় জানিয়েছিলেন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে আপস করা হবে না। কাঁথির সভার দিনই মারিশদার পঞ্চায়েত প্রধান–সহ তিনজনকে পদ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন অভিষেক। তারপর হলদিয়ায় ইউনিয়ন থেকে ঠিকাদারদের সরানো হয়েছে। যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন তাঁরা শুভেন্দু অধিকারী ঘনিষ্ঠ বলে সূত্রের খবর।
ঠিক কারা গ্রেফতার হলেন? পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তিন নেতা—হলদিয়ার প্রাক্তন কাউন্সিলর প্রশান্ত দাস, শান্তিপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সেলিম আলি এবং শহিদ মাতঙ্গিনী পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি দিবাকর জানাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। এর আগে শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ শ্যামল আদককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে অভিষেকের নির্দেশে তৃণমূল কংগ্রেস এভাবে একের পর এক ব্যবস্থা নেওয়ায় খুশি মানুষ। ‘এক ডাকে অভিষেক’ শুরু হয়েছিল সাধারণ মানুষের অভিযোগ শোনার জন্য। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে অভিযোগ এলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলা হয়েছিল। প্রমাণ মিলল, মঙ্গলবার শান্তিপুর ১ পঞ্চায়েত প্রধানকে পদত্যাগ করতে বলার পরের দিনই গ্রেফতারে। এই তিন নেতারই উত্থান হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে। প্রাক্তন কাউন্সিলর প্রশান্ত এবং পঞ্চায়েত প্রধান সেলিমের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ সিপিআইএম থেকে। আর দিবাকরের উত্থানেও দল কোনও ব্যবস্থা নিতে পারত না শুভেন্দুবাবুর ঘনিষ্ঠ বলেই। এখন শুভেন্দু বিজেপিতে যেতেই দিবাকরকে বহিষ্কার করা হয় তৃণমূল কংগ্রেস থেকে।
আর কী জানা যাচ্ছে? দু’দিন আগে গ্রেফতার করা হয়েছে কাঁথির শ্মশান কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ঠিকাদার রামচন্দ্র পণ্ডাকে। তিনি শুভেন্দুর ভাই সৌমেন্দুর ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। শুভেন্দুর হাত ধরে ঘাসফুলে নাম লেখানো হলদিয়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রশান্ত দাসের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে বিস্তর অভিযোগ ছিল। সম্পর্কে তিনি হলদিয়ার বিজেপি বিধায়ক তাপসী মণ্ডলের মামা। এই ঘটনায় কুমারচকের বাসিন্দা জাহাঙ্গির হোসেন দুর্গাচক থানায় অভিযোগ করেন, তাঁকে চাকরি দেওয়ার নামে লক্ষাধিক টাকা নিয়েছেন ওই নেতা। তখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রশান্তকে ডাকা হয়। জেরায় অসঙ্গতি ধরা পড়তেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।
ঠিক কী বলছে পুলিশ? এই গ্রেফতারের বিষয়ে মহিষাদল পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর মানবেন্দ্র পাল বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া প্রশান্ত দাসের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে কয়েকজনকে প্রতারণা করার অভিযোগ ছিল। টাকা হাতানোর অভিযোগ এসেছে। শুধু জাহাঙ্গির হোসেন না, চাকরি দেওয়ার নামে ১০ জন যুবকের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’ হলদিয়ার এক কারখানায় অনিয়মের অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। শান্তিপুর ১ পঞ্চায়েত প্রধান সেলিমের বেনামে বহু সম্পত্তি রয়েছে বলে ‘এক ডাকে অভিষেক’-এ অভিযোগ জমা পড়েছিল। দল তদন্ত করে তার সত্যতা পায়। সেলিমকে পুলিশ গ্রেফতার করে। দিবাকর জানার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে থাকাকালীন একটি কোম্পানি খুলে ঠিকাদারি করতেন। প্রভাব খাটিয়ে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোটি কোটি টাকার স্টোন বোল্ডার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। শুভেন্দু অধিকারীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় পার পেয়ে যান দিবাকর। এমনকী কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেরই এক উচ্চপদস্থ কর্তাকে মারধরের অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। দলও তাঁকে সাসপেন্ড করে। শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগদানের পর গোপনে ভোট করানোর অভিযোগে বহিষ্কৃত হন দিবাকর। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার অমরনাথ কে জানান, কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে দিবাকর জানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তমলুক সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি সৌমেন মহাপাত্র বলেন, ‘এই পদক্ষেপ স্বাগত। দলে স্বচ্ছতা ফিরুক। এতে মানুষের আস্থা বাড়বে। পঞ্চায়েত ভোটের ফল আরও ভাল হবে।’