মালদা: বঙ্গদেশে চড়ক মানেই একরকম মহোৎসব। চড়ক উপলক্ষে সারা বাংলা জুড়ে নানা লোকসংস্কৃতির আয়োজন হয়। তেমনই একটি লোকনাট্যধারা ‘অষ্টকগান’। কখনও রাধাকৃষ্ণের মিলন-বিরহের সুর তোলে, কখনও বেহুলা লখিন্দরের কাহিনি শোনায় অষ্টক। অবিভক্ত বাংলাদেশের ফরিদপুর, চুয়াডাঙা, কুষ্ঠিয়ায় একসময় বেশ প্রচলিত ছিল। গত শতকে দেশভাগ অষ্টকশিল্পীদের তাড়িয়ে আনে এপার বঙ্গে। মালদা জেলায়। মালদার বেশ কিছু ব্লকে এখনও চর্চিত এই লোকসংস্কৃতি। চড়কের সময় ২০-২৫ দিন ধরে চলে নৃত্যগীতসমন্বিত অষ্টক পালা। কিন্তু শিল্পীদের খেদ একটাই। রাজ্য সরকারের লোকপ্রসার প্রকল্পে তাঁরা আজও ‘নিখোঁজ’। তাই জুটছে না প্রাপ্য অনুদান।
সমস্যা ঠিক কোথায়?
রাজ্য সরকারের লোকপ্রসার প্রকল্পে বর্তমানে অনুদান পাচ্ছেন ১ লক্ষ ৮১ হাজার শিল্পী। প্রতি মাসে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকছে ১০০০ টাকা অনুদান। কিন্তু জেলা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের খাতায় নাম নেই অষ্টকশিল্পীদের। সমস্যা ঠিক কোথায়? কোন গাফিলতির জন্য এই পরিস্থিতি? সরোজমিনে খতিয়ে দেখল HT বাংলা।
‘৩-৪ বছর ধরে ঘুরছি’
বিকেলের আলো পড়ে আসছে। কথা হচ্ছিল হবিবপুর ব্লকের আড়াগাছি গ্রামের কিরণ বিশ্বাসের সঙ্গে। প্রতি বছর চড়ক এলেই ৬-১২ জনের দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েন। কিরণের কথায়, ‘শিল্পী হলেও আমরা গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের অনুদানটা পেলে সংসার চালাতে সুবিধা হত।’ আবেদন করেছিলেন অনুদানের জন্য়? ‘গত তিন-চার বছর ধরে ঘোরাঘুরি করছি। জেলার সহায়তা কেন্দ্রে একবার গেছিলাম। কিন্তু বলল, ফর্ম ছাড়েনি এখনও। কদিন আগেও গেছিলাম। একই কথা।’ দীর্ঘদিন ২০-৩০ বছর ধরে অষ্টক গাইছেন পাকুয়াহাটের আনন্দ হালদার। তিনি জানাচ্ছেন ‘এক দাদা বলেছিল নিয়ে যাবে ফর্ম ভরার জন্য। সে আর তারপর কিছু বলল না। কোথায় খোঁজ করব তাও জানি না। আমরা হয়তো এখনও সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। তাই ভাতা পাচ্ছি না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পী বললেন, ‘খোল করতাল বাজাতে না পারলেও দেখেছি একজন দিব্যি এই অনুদান পাচ্ছে। কীভাবে পায় বুঝি না।’ তাহলে কি কোনও ‘বিশেষ’ যোগ থাকতে হয়?
‘সমস্য়ার শুরু যেখানে’
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মধ্যে ঘোষণা করেছিল শিল্পীদের জন্য লোকপ্রসার প্রকল্প। ২০১৩ সালে ঘোষণার পর ২০১৪-র আগস্টে শুরু হয় আবেদন প্রক্রিয়া। প্রতি জেলা থেকেই হাজার হাজার আবেদন জমা পড়তে থাকে। নিয়ম মেনে আবেদন ঝাড়াই বাছাই করার পর শুরু হয় অনুদান দেওয়া। ২০১৭ সালের মে মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নতুন করে আবেদনের প্রক্রিয়া। সরকারি ওয়েবসাইট (wblpp.in) বলছে বর্তমানে ১,৮১,৬৭৮ জন শিল্পী এই অনুদান পাচ্ছেন। সমস্যা শুরু হল আবেদন প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পর।
শিল্পীদের গাফিলতি?
আবেদন বন্ধ হওয়ার পর একাধিক জেলা থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে। লোকশিল্পীরা তাদের নাম নথিভুক্ত না হওয়ার অভিযোগ করতে থাকেন। আজও সেই অভিযোগের ধারা অব্যাহত। জেলা তথ্যসংস্কৃতি দফতরের এক সূত্র জানাচ্ছে, শিল্পীদেরও কিছুটা গাফিলতি রয়েছে। যখন প্রকল্পটির ঘোষণা হয়, তখন হোর্ডিং, ট্যাবলো ইত্যাদি নানাভাবে জেলা দফতর প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ যতজন আবেদন করলেন, সেই সংখ্যা অনেকটাই কম। সরকারি ওয়েবসাইট (wblpp.in) বলছে, মালদায় বর্তমানে ৩৫৪৫ জন লোকশিল্পী সরকারি অনুদান পাচ্ছেন।
২০২৩ সালের রিপোর্ট
গত বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ এই সময় সংবাদমাধ্যমে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেটি জানাচ্ছে, লোকপ্রসার প্রকল্প ফের শুরু হওয়ার কথা। জেলায় জেলায় নির্দেশিকা চলে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে বিভিন্ন জেলার আধিকারিকরা জানান, নির্দেশিকা মেনে কাজ শুরু হবে। মালদা জেলার তথ্যসংস্কৃতি দফতরের সঙ্গে কথা বললেও এই বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য হল না।
অষ্টকগান স্বল্পপরিচিত বলেই?
কিন্তু ৩,৫৪৫ জন লোকশিল্পীর মধ্যে অষ্টকশিল্পী কেউই নন? কী করে সম্ভব? অষ্টক অবিভক্ত বাংলাদেশের হলেও দেশভাগের পর কোথাও কোথাও উদ্বাস্তুদের লোকসংস্কৃতি তকমা পেয়েছে। যেহেতু শিল্পীরা পাবনা, ফরিদপুরের। শিল্পীদের সংখ্যাও অন্যান্য লোকশিল্পগুলির থেকে বেশ কম। অষ্টকগান নামে একটি লোকশিল্প রয়েছে, এই ব্যাপারে কি জেলা তথ্যসংস্কৃতি দফতর অবগত? প্রশ্ন শুনে একটু থেমে ওপাশের ‘সূত্র’ বললেন, ‘কারা অনুদান পাবেন, সেটা তথ্যসংস্কৃতি দফতর ঠিক করে না। ফোক অ্যান্ড ট্রাইবাল কালচার (এফটিসি) একটি তালিকা পাঠায় শিল্পগুলোর নাম উল্লেখ করে। সেই লোকশিল্পের শিল্পীদেরই অনুদান দেওয়া হয়। হয়তো এফটিসি লিস্টে অষ্টকগান নেই। তাই…।’ এর ভিত্তিতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রতিবেদন লেখা। লেখার মাঝেই হঠাৎ ‘সূত্র’-র ফোন। ‘খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনজন অষ্টক শিল্পীর নাম নথিভুক্ত আছে। সম্ভবত বাকিরা সঠিক সময়ে আবেদন করেনি বলেই অনুদান পাচ্ছেন না।’ ইতিমধ্যে দফতরে কথা বলে এফটিসি লিস্ট দেখার অনুরোধ করেছিল প্রতিবেদক। হাসিমুখে একজন জানালেন, ‘তালিকা এখন কোথায় আছে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কালকে এখানে যাত্রা উৎসব বলে সকলে ব্যস্ত। বুঝতেই পারছেন…’ বুঝতে পারা গেল সরকারি আপিসের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে কাগজ-পাহাড়ের তলায় চাপা পড়েছে তালিকা। তাই হাতের কাছে নেই।
অষ্টকশিল্পীদের আনুমানিক সংখ্যা
তবে তালিকা ততটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। কারণ লিস্টে নাম থাকা বা না থাকা একটি লোকশিল্পের অস্তিত্ব আছে কি নেই, ঠিক করে দেয় না। সূত্র মারফত জানা গিয়েছিল, তিনজন অষ্টক শিল্পী বর্তমানে ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু অষ্টক শিল্পীর সংখ্যার তুলনায় তা নেহাতই নগণ্য। মালদা জেলা জুড়ে অষ্টকশিল্পীদের সংখ্যা কমবেশি ১০০ থেকে ২০০-র মধ্যে। মালদার দাল্লা, আড়াগাছি, বুলবুলচণ্ডী, আগ্রা-হরিশচন্দ্রপুর, পাকুয়াহাট, আদাডাঙ্গা, আঁতলা, শোনঘাট, হাঁসপুকুর, পার্বতীডাঙ্গা, শ্রীবিষ্ণুপুর, খোকসন, কৃষ্ণনগর, পোলাডাঙা ইত্যাদি গ্রামে অষ্টক গান আজও প্রচলিত । প্রতি অষ্টক গানের দলে গায়ককে নিয়ে মোট ৫-৬ জন থাকেন। কিছু দলে গানের দলের সঙ্গে অভিনয়ের একটি দল থাকে। অভিনয়ের দলে আরও ৫-৬ জন। সব মিলিয়ে ভালোরকম বড় দল হলে ১২ জনের দল। ছোট দল হলে ৬ জনের দল। মালদার কমবেশি ১৫টি গ্রামে তাই অষ্টকশিল্পীদের সংখ্যা ১০০ থেকে ২০০ জনের মধ্যে। তার মধ্যে মাত্র তিনজন পাচ্ছেন অনুদান। গাফিলতি কোথায়? প্রশাসন পৌঁছাতে পারছে না শিল্পীদের কাছে? না শিল্পীরা জানে না কীভাবে পৌঁছাতে হয় সরকারের কাছে? শিল্পীরা পদ্ধতি না জানলে, সমীক্ষার মাধ্যমেও কি তাঁদের খুঁজে বার করা সম্ভব নয়? প্রশ্ন থাকছে।
আশ্বাস আপাতত যেটুকু
অ্যাপায়নে খামতি রাখেন না কিরণ বিশ্বাস। উঠে আসার সময় লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘দিদি চাইলে কী না হয়! একটু যদি আপনারা আমাদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছে দেন, উপকার হবে খুব।’ ‘নিশ্চয়ই, সে চেষ্টাই করব’ বলে আশ্বস্ত করে আসতে হয়। আশা জুগিয়ে আসতে হয়, নিশ্চয়ই আবার শুরু হবে আবেদন প্রক্রিয়া। কোনও বিশেষ যোগ না থাকলেও অনুদান পাবেন অষ্টকশিল্পীরা।