রবীন্দ্রজয়ন্তীকে রাজ্য সফরে এসে কার্যত নির্ভেজাল অরাজনৈতিক একটি দিন কাটিয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গোটা দিনে রাজনীতির কোনও কথা শোনা যায়নি তাঁর মুখে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বজনীন করে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন। উলটো দিকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানে নানা ভাবে শাহের সফরের সমালোচনা করেন তৃণমূল নেতারা। ফিরহাদ হাকিম থেকে ব্রাত্য বসু হয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শাহকে উদ্দেশ করে শোনা যায় কটাক্ষ। এমনকী নাম না করে তাঁকে কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এতেই তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি রবীন্দ্র জয়ন্তীতে অমিত শাহের সফরে শঙ্কিত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের ‘বহিরাগত’ ক্যাম্পেন ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। যার ফলে আরও বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই বলে হাল ছাড়েননি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও। তাঁরাও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তারই অঙ্গ হিসাবে গত মঙ্গলবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসেন অমিত শাহ। প্রথমে ঠিক ছিল সেদিন সকালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিকেলে বহরমপুরে দলীয় সভা করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু রবীন্দ্র জয়ন্তীকে রাজনৈতিক আখড়ার বাইরে রাখতে শেষ বেলায় সেই সভা বাতিল করে বিজেপি। তার বদলে ওই দিন বিকেলে কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে রবীন্দ্র জয়ন্তীর একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করেন তিনি। বুধবার জানা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে বিশ্বভারতীকে হেরিটেজ সেন্টারের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। এই প্রথম কোনও চালু বিশ্ববিদ্যালয়কে এই স্বীকৃতি দিল তারা।
ওদিকে ওই দিন সকাল থেকে শাহকে আক্রমণ শুরু করেন তৃণমূল নেতারা। কোনও প্ররোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তাঁর সফরকে কটাক্ষ করেন ফিরহাদ হাকিম, ব্রাত্য বসু, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শীর্ষস্তরের নেতারা। এমনকী বাদ যাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নাম না করে সরকারি মঞ্চ থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আক্রমণ করেন তিনি।
ওই দিন সকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আক্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, পরিহবণমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘বাঙালি আবেগকে উনি কখনওই নাড়া দিতে পারবেন না। ২১এও পারেননি, আর ২৪এও পারবেন না। এবার ৩৫ হবে না, ০ থেকে যাবে।' বেলা বাড়লে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘আমি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর নেব পরে, মূর্তিগুলো ঠিক আছে কি না।’ বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধনধান্য অডিটোরিয়ামে সরকারি রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা যেন কখনও না ভাবি, নির্বাচনের প্রয়োজনে ৫ টাকায় কাউকে কাউকে কিনতে পাওয়া যায়। এমনকী ভুল করে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান সেকথাও বলা যায়। বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভেঙে ফেলা যায়। আবার নির্বাচনের কারণে না জেনে লিখে নিয়ে এসে অথবা টেলিপ্রম্পটারে লিখে নিয়ে এসে অনেক বড় বড় কথা বলা যায়।’
এর পর বীরভূমের মুরারইতে নব জোয়ার কর্মসূচির এক সভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা গরুচোর ধরেত বেরিয়েছি। আর ইডি বলছে, গরু চুরি করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিয়েছে বিএসএফ। বিএসএফ কার অধীনে? অমিত শাহ। ক্ষমতা আছে ডেকে অমিত শাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে? বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে দিল্লি। তদন্ত তদন্তের পথে চলবে আমি কারও হয়ে ওকালতি করব না। ১৫০ গুণ সম্পত্তি তার মেয়ের বেড়েছে বলে সুকন্যা মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে। অমিত শাহের ছেলে ৮০ হাজার গুণ সম্পত্তি বেড়েছে। কেন অমিত শাহের ছেলেকে গ্রেফতার করা হবে না? কেন অমিত শাহকে গ্রেফতার করা হবে না? এই বিএসএফ কার অধীনে? বিএসএফ স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম কী? অমিত শাহ। তাহলে বিএসএফ গরু পাচার করে যে টাকা রোজগার করে তার টাকা অমিত শাহের কাছে যায় না তার ছেলের কাছে যায়? কে প্রশ্ন করবে? একমাত্র আমরা চোখে চোখ রেখে লড়াই করছি। আগামী দিনে আগামী দিনে ব্যতিক্রম হবে না’। নব জোয়ার কর্মসূচি থেকে এই প্রথম এব্যাপারে আক্রমণ করেন তিনি।
তৃণমূল নেতৃত্বের এই আচরণে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তবে কি শাহের সফর নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা বিপন্ন বোধ করছেন? নইলে কোনও প্ররোচনা ছাড়া বারবার তাঁকে আক্রমণ কেন? তাও রবীন্দ্রজয়ন্তীর মতো একটি অরাজনৈতিক দিনে। উত্তর ২৪ পরগনার এক তৃণমূল নেতা বলেন, অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান বা দিনে এই ধরণের রাজনৈতিক আক্রমণ সাধারণ মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। এতে হয়তো কিছু দলীয় কর্মী উজ্জীবিত হন। কিন্তু মোটের ওপর দলের ক্ষতিই হয়। দলীয় বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?