২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের শহর ও শহরতলির হিন্দিভাষী ভোটারদের মন এবং ভোট জিতেই পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বিজেপি। আর হারানো সেই ভোট ব্যাঙ্কে ফের কব্জা করতেই সোমবার দলে ত্রিস্ত্ররবিশিষ্ট হিন্দি সেলের সূচনা করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দিকে অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেয় গণপরিষদ। তার পর থেকে এই দিনটিকেই হিন্দি দিবস হিসেবে পালন করে আসা হচ্ছে। আর এই শুভ দিনেই হিন্দি সেলের পুনর্গঠন করা হল পশ্চিমবঙ্গে। হিন্দিভাষী অধ্যুষিত ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের প্রাক্তন সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীকে এই পুনর্গঠিত হিন্দি সেলের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এই হিন্দি সেলকে কাজের বিস্তার অনুযায়ী তিন স্তরের কাঠামোতে ভাগ করা হয়েছে। রাজ্য স্তরের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি, জেলা স্তরের কমিটি এবং ব্লক স্তরের কমিটিতে এবার থেকে কাজ হবে।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়েছেন, হিন্দি সেলের এই গঠনগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতেই নেওয়া হয়েছে। এর আগে বিজেপি, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছেন প্রশান্ত কিশোর। ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি বিজেপি–র দখলে চলে গেলে ওই রাজনীতিবিদের দ্বারস্থ হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে বেশ বেকায়দায় ফেলতে পারে বিজেপি।
তৃণমূলের এক নেতা জানান, তৃণমূলের পুরনো হিন্দি সেল একেবারেই সক্রিয় ছিল না। তবে এবার সেটিকে সক্রিয় করা হচ্ছে। বিবেক গুপ্তকে এই সেলের সভাপতি নিয়োগ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সোমবার হিন্দি দিবস উপলক্ষে টুইট করে রাজ্য তথা দেশের হিন্দিভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি টুইটে লেখেন, ‘বাংলার এই মাটিতে সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত। এই রাজ্য বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা সব সময় চালিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলায় হিন্দি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং হিন্দি সম্প্রদায়ের কল্যাণের হেতু বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এসেছে।’
টুইটে মুখ্যমন্ত্রী আরও লিখেছেন, ‘রাজ্য সরকার হিন্দি, উর্দু, গুরমুখী, অলচিকি, রাজবংশী, কামতাপুরী, কুরুখ ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে সব ভাষাভাষির মানুষের বিকাশের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের কাছে আমার অনুরোধ, NEP 2020–র ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যা প্রয়োজন তা করা হোক।’ ওদিকে, এদিন দীনেশ ত্রিবেদীও একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে হিন্দিতে বক্তব্য রাখেন। জাতিগত ভাষাগুলিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন সে ব্যাপারে বৈঠকে বলেন তিনি।
মেদিনীপুরের সাংসদ ও রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ লোকসভায় হাজির থাকতে সোমবার দিল্লিতে গিয়েছিলেন। তিনি সেখান সাংবাদিকদের এদিন বলেন, ‘এত বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে আসছেন যে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাভাষা সবার ওপরে, সবার সেরা জায়গায় পৌঁছবে। আর এখন হঠাৎ তিনি হিন্দিভাষী নেতাদের বিভিন্ন কমিটি, সংগঠনে শীর্ষে জায়গা দিচ্ছেন। কোনও দল এভাবে চলতে পারে না। তিনি বিজেপি–র অনুকরণ করছেন। কিন্তু আমরা যে নীতিগুলি অনুসরণ করি তা তিনি মানতে চান না, পারবেনও না।’
কলকাতার বাসিন্দা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এখন এমন মনে হচ্ছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দিভাষাকে ব্যবহার করেই ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান।’
তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পুনর্গঠিত এই হিন্দি সেলকে তিন স্তরের কাঠামোতে ভাগ করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে এটি দলের মধ্যে হিন্দি সম্প্রদায়ের লোকদের বৃহত্তর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। তার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি প্ল্যাটফর্মও তৈরি করবে এই সেল। তাদের অভিযোগগুলির সমাধান করার পাশাপাশি বাংলায় সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মযজ্ঞে সামিল হতে পারবেন হিন্দীভাষী মানুষ।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এই হিন্দি সেল বাংলায় হিন্দি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং হিন্দিভাষী সম্প্রদায়ের সামগ্রিক কল্যাণে সক্রিয়ভাবে কাজ করার চেষ্টা চালাবে। আমরা মনে করি ২০১১ সালে শুরু হওয়া এই কাজ এবার এই পুনর্গঠিত হিন্দি সেলের মাধ্যমে আরও বিস্তার লাভ করবে।’
২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর আসনে তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো অর্জুন সিংয়ের কাছে হেরে যান দীনেশ ত্রিবেদী। অর্জুন সিংয়ের ছেলে এবং ভাই ব্যারাকপুরের দুই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক। বিজেপি–নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য লোকসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে হিন্দিভাষী লোকজনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে মেদিনীপুর, আসানসোল এবং দার্জিলিংয়ে।