প্রীতি দাস ও পাপড়ি দাস ( নাম পরিবর্তিত) যমজ বোন। নবম শ্রেণির ছাত্রী। দু'জনের একটা ফেসবুক প্রোফাইল। ভাগাভাগি করে পোস্ট দেয়। আবার কখন আবার এক সঙ্গে। হঠাৎ একদিন ম্যাসেঞ্জারে একটি ম্যাসেজ আসে টিভির জনপ্রিয় একটি রিয়েলিটি শো-র নাম করে। ম্যাসেজে বলা হয় রিয়েলিটি শো'তে অংশগ্রহণ জন্য নাম নথিভুক্ত করা চলছে, তারা অংশগ্রহণ করতে রাজি কি না। দু’জনে এমন অফার পেয়ে বেশ কিছুটা বিস্মিত আবার আনন্দিতও বটে। তাঁরা রাজি হয়ে যায়।
এরপর তাদের একটা ফর্ম পাঠানো হয়, বলা হয়, ওই ফর্মটি পূরণ করে পাঠাতে। ফর্মে জনপ্রিয় ওই টিভি শো-এর সঞ্চালিকার ছবিও ছিল। ফলত তাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়নি। ফর্মটি তারা পূরণ করে পাঠিয়ে দেয়। এর পর তাদের বলা হয় নগ্ন হয়ে ছবি তুলে পাঠাতে। কারণ, জানতে চাইলে বলা হয়, অডিশনের জন্য সম্পূর্ণ নগ্ন ছবি লাগবে। তাদের বলা হয়, আগেও যাঁরা এই ভাবে অডিশন দিয়েছিল তাঁরা নগ্ন ছবি পাঠিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে, ম্যাসেঞ্জারে দু'টি ছবি পাঠিয়ে ছিল তারা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবিগুলো মুছে দেয়। প্রীতি ও পাপড়ি বুঝে যায় তাদের অভিসন্ধি। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাদের ফোন নম্বর চলে গিয়েছে সাইবার দুষ্কৃতীদের হাতে। শুরু হয় দ্রুত ছবি পাঠানোর জন্য ফোন, মেসেজ। কিন্তু ইতিবাচক উত্তর না পেয়ে তারা এবার হুমকি দিতে শুরু করে। বলা হয়, ছবি না দিলে তাদের বাবা-মাকে খুন করে ফেলা হবে। এত দিন পর্যন্ত মেয়ে দু'টি তাদের পরিবারের লোককে এই সব ঘটনার কথা কিছুই জানায়নি। কিন্তু, হুমকি শুরু হতেই তারা ভয় পেয়ে বাবাকে সব কথা বলে। মেয়ে দু'টি এতটাই ভয় পায় যে, প্রথমদিকে তাঁরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়ে ফেলে। বাবা জানতে পেরেই, তাঁদের বলে, ফোনের সিম বদলে ফেলতে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে। এক বন্ধু তাঁকে পুলিশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি যেতে আগ্রহ দেখানি। তাঁর কথায়, পুলিশে গিয়ে ঝামেলা অনর্থক বাড়বে, লোক জানাজানি হবে।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য মেয়ে দু'টির ক্ষেত্রে খারাপ কিছু হয়নি। তবে সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ক্রাই – চাইল্ড রাইট্স অ্যান্ড ইউ-এর এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, শিশুদের বিরুদ্ধে অনলাইন যৌন হেনস্থা ও অপরাধের প্রতিকারে কী-কী আইন রয়েছে, তা নিয়ে আদৌ ওয়াকিবহাল নন শতকরা ৯০ জন অভিভাবকই। এমনকী সন্তান অনলাইন যৌন হিংসার শিকার হলে তা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হতেও অনীহা রয়েছে তিন-চতুর্থাংশ অভিভাবকের। পটনার চাণক্য ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি-র সহযোগিতায় ‘পকসো অ্যান্ড বিয়ন্ড: আন্ডারস্ট্যান্ডিং চাইল্ড অনলাইন সেফটি ডিউরিং কোভিড’ নামে ক্রাই এই সমীক্ষাটি চালিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটক – এই চার রাজ্যের অভিভাবক, সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, পুলিশকর্মী, প্রশাসনিক আধিকারিক ও আইনি পেশার সঙ্গে যুক্ত নাগরিকদের মধ্যে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে।
কী কারণে বাড়ছে শিশুদের উপর অনলাইন যৌন অপরাধের ঘটনা?
কোভিডের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনা ও অন্যান্য কারণে অনলাইন মাধ্যমের প্রতি শিশুদের নির্ভরতা অনেকটাই বেড়েছে। বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে শিশু ও কিশোররা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই বেশি সক্রিয়। বাবামায়ের পক্ষে তাঁদের পেশাগত ব্যস্ততার কারণে সবসময় শিশুদের ওপর সবসময় নজর রাখা সম্ভব নয়। ফলে, অনলাইন মাধ্যমে শিশুরা কাদের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটাচ্ছে, কী ধরনের তথ্যের আদানপ্রদান করছে, এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল কী হতে পারে – সে বিষয়ে তাঁরা প্রায়ই ওয়াকিবহাল নন। পাশাপাশি, বয়সোচিত কৌতূহলের কারণে এবং অনলাইন মাধ্যমের ক্ষতিকর দিকগুলির বিষয়ে অনবহিত থাকার ফলে শিশুদের অনলাইন যৌন অপরাধ ও হিংসার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি।
তাছাড়া, ওই সময় কালে অনলাইনের মাধ্যমে শিশুপাচার ও শিশুদের পর্নোগ্রাফির বিষয় করে তোলার ব্যাপারে অপরাধীদের সক্রিয়তা অনেকাংশে বেড়েছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ক্রাই-এর পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা তৃণা চক্রবর্তী বলেন, ‘সমীক্ষার রিপোর্ট থেকেই পরিষ্কার, সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নিলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষত অভিভাবকদের মধ্যে এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে। শুধু সচেতনতাই নয়, শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন অপরাধের মোকাবিলায় যে সমস্ত আইনি প্রতিবিধান রয়েছে, সে বিষয়েও তাঁরা সম্যক ওয়াকিবহাল নন। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অভিভাবক ও শিক্ষকরা যতক্ষণ সচেতন না-হচ্ছেন, সন্তান ও ছাত্রছাত্রীদের সচেতন না-করছেন, এবং বিপদের সম্মুখীন হলে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পুলিশ প্রশাসনের কাছে না-পৌঁছচ্ছেন – ততক্ষণ অনলাইন মাধ্যমকে শিশুবান্ধব পরিসরে পরিণত করার সময়োপযোগী সব উদ্যোগই অসমাপ্ত রয়ে যাবে।’
সচেতন নয় শিক্ষকরাও
শুধু অভিভাবকরাই নন, শিক্ষকদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে বলে সমীক্ষাটি জানিয়েছে। শিশুরা যে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অনলাইনে কাটাচ্ছে, সে-বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন বলে জানিয়েছেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া এ-রাজ্যের প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষক। অনলাইন সুরক্ষা বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে কখনও আলোচনা করেছেন কি না, সে প্রশ্নেও ৫৮ শতাংশ শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। সন্তানের অনলাইন সুরক্ষায় অভিভাবকদের পুলিশের দ্বারস্থ না-হওয়ার প্রবণতা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে লোকলজ্জা ও সমাজে সম্মানহানির আশঙ্কাকে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষকদের ৮০ শতাংশ।
সমাধান কোন পথে?
অনলাইন মাধ্যমে শিশুরা কী করছে, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সরাসরি কথা বলা এবং অনলাইন মাধ্যমের সম্ভাব্য বিপদগুলির বিষয়ে শিশুদের অবহিত করে তোলাই সমাধানের সবচেয়ে জরুরি পথ, এমনটাই মনে করেন তৃণা চক্রবর্তী। একইসঙ্গে, শিক্ষক ও অভিভাবকরা অনলাইন অপরাধের বিভিন্ন দিকগুলি বিষয়ে যাতে নিজেরাও সচেতন থাকেন, এবং শিশুদের বিরুদ্ধে অনলাইন অপরাধের ঘটনা ঘটলে যাতে তৎক্ষণাৎ পুলিশ-প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তবেই এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে এগনো যাবে বলে তিনি মনে করেন।