বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। আজ, শুক্রবার তাঁর দেহ এনআরএস হাসপাতালে দান করা হচ্ছে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন তাঁর। এমনকী জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষভাবে পরিচিতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কারণ তাঁর হাতেই বাংলার ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার সময় কখনও কুকথা বলতে শোনা যায়নি। রাজনীতিতে ‘শ্বেতশুভ্র ভদ্রলোক’ বলেই পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজনীতিতে কুকথা ব্যবহারে তিনি রাজি ছিলেন না। আর সেটা যদি তাঁর দল করত, তাতেও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এই বিষয়ে নিজের অবস্থান খোলাখুলিভাবে বেসরকারি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। যা আজও প্রাসঙ্গিক।
সালটা ছিল ২০১৩। এক বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজনীতিতে কুকথার ব্যবহার নিয়ে মুখ খোলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তখন সিপিএম–তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে রাজ্যে দ্বৈরথ চরমে উঠেছে। দু’দলের নেতারাই পরস্পরকে তীব্র আক্রমণ করে চলেছেন। আর তখন কয়েকজনের ভাষা ব্যবহারে লাগাম থাকছিল না। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অথচ আজ এই রাজ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস–বিজেপির মধ্যে কুকথা ব্যবহার অনেকটা বেড়েছে। যা রাজ্যের মানুষের পছন্দ নয়। বুদ্ধবাবুকে প্রশ্ন করা হয়, কুকথার ব্যবহার চরমে উঠেছে। এই বিষয়ে প্রতিযোগিতা হলে কারা জিতবে, আপনারা না তৃণমূল? উত্তর দিয়েছিলেন তিনি।
এই কুকথা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উত্তর ছিল, ‘আমাদের যে ভুল হচ্ছে, সেটাকে লঘু করছি না। আমারও মন খারাপ হয় ওসব শুনে। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং বৃহত্তর অর্থে রাজ্যে সংস্কৃতির সবচেয়ে সুন্দর ধারাটি বামপন্থীদের তৈরি করা। চার–পাঁচের দশক থেকে বামপন্থী মানেই সংস্কৃতি। পারফর্মিং আর্টস, সাহিত্য, গান, নাটক, ছবি আঁকা—সবেতেই বামপন্থীরা ছিলেন। আমরা সেই ধারাকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে। এই ব্যতিক্রম অন্যায়ও। কিন্তু তৃণমূলের এটাই মূল ধারা। আমাদের সঙ্গে এটাই ওদের পার্থক্য।’
আরও পড়ুন: বামফ্রন্ট সরকার পতনের নেপথ্য কারণ কী? প্রকাশ্যে বলে গিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
রাজনীতিতে কুকথা ব্যবহার নিয়ে চিন্তিতও ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা ভেবে আমার কাছে বিষয়টি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। যাঁরা কলেজে পড়ছেন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ঘাঁটছেন, এসব দেখে তাঁদের মনে হবে, এটাই কি রাজনীতি? এঁদের দেখে রাজনীতি করব? আমাদের একটা অন্য স্তরের জীব ভাবছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। খারাপ লাগে এটা ভেবে যে, কী করতে এলাম রাজনীতিতে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা আমাদের ঘৃণা করে!’ সেদিন শোনা গিয়েছিল আক্ষেপ। আজ সব ছেড়ে চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রেখে গেলেন তাঁর শিক্ষা, সংস্কৃতি।
সেদিন নিজের মনের কথা বলার পাশাপাশি অতীতের স্মৃতিও তুলে ধরেছিলেন বুদ্ধবাবু। তাঁর কথায়, ‘আমাদের সময় কংগ্রেস, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট নেতাদের দেখেছি, সব সেরা মানুষজন ছিলেন। আমার হেডমাস্টার ছিলেন কমিউনিস্ট কর্তা। আজীবন ওঁকে শ্রদ্ধা করেছি। আমরা যাঁরা রাজনীতি করি, একটা মূল্যবোধে বিশ্বাস করি। আজকের ছেলেমেয়েরা দেখছে, রাজনীতিতে খারাপ ভাষা। আমাদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করবে তো! আর তা থেকে বামপন্থীরাও বাদ যাবে না। তাহলে কী রেখে গেলাম রাজনীতিতে? এটাই আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাবমূর্তি রক্ষা না হলে, সব শেষ হয়ে যাবে।’