নিউটাউনে এসটিএফের হাতে খতম হয়েছে পাঞ্জাবি গ্যাংস্টার জয়পাল সিং ভুল্লার। কিন্তু জীবনের শুরুতে সে ছিল অন্য একটি ছেলে। অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্টেন্ট সাব ইনস্পেক্টরের ছেলে জয়পাল অপরাধ জগতে প্রবেশের আগে ২০০৩ সালে লুধিয়ানায় পাঞ্জাব সরকারের স্পোর্টস ট্রেনিং সেন্টার স্পিড ফান্ড অ্যাকাডেমির ছাত্র ছিল। হ্যামার থ্রোয়ার হিসাবে দক্ষ ছিল। ওই অ্যাকাডেমিতে পরিচয় হয় আমনদীপ সিং ওরফে হ্যাপির। সে শারীরিক কসরত করত। হ্যাপির বাবাও ছিল সাব–ইন্সপেক্টর। গত মাসেই লুধিয়ানায় পালিয়ে বাঁচতে গুলি চালিয়ে খুন করেছিল দুই পুলিশ অফিসারকে। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে হ্যাপি ও জয়পাল মিলে নিকটাত্মীয়র ছেলে চিরাগকে অপহরণের ছক কষে। দ্রুত ধনী হতে চেয়েছিল তারা। তবে সফল হয়নি। লুধিয়ানার জেলে ঠাঁই হয় জয়পাল ও হ্যাপির। জেলে রাজীব ওরফে রাজার সঙ্গে আলাপ হয় জয়পালের। ২০০৬ সালে লুধিয়ানার তিনজন গয়না দোকানিকে খুন ও লুঠের দায়ে অভিযুক্ত ছিল রাজা।
তারপর থেকে অপরাধ বেড়েই চলে। ২০০৯ সালে হোসিয়ারপুরের কারখানা থেকে বন্দুক লুঠ করে তারা। এরপর পঞ্চকুল্লা ও মোহালিতে ব্যাঙ্ক ডাকাতি, চণ্ডীগড়ের ব্যবসায়ী এবং বিজেপি নেতাকে লুঠ এবং হাইওয়ে থেকে গাড়ি ছিনতাই করে। হরিয়ানায় গ্যাং চালাত রাজা। পাঞ্জাবে জয়পাল। ২০১৬ সালে বিপরীত গ্যাংস্টার জসবিন্দর সিং ওরফে রকিকে হিমাচল প্রদেশে খুন করার পর ফেসবুকে এই কথাগুলিই লিখেছিল জয়পাল সিং ভুল্লার। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্যাংস্টার তার সঙ্গীদের নিয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ–সহ চারটি রাজ্যে একের পর খুন–ডাকাতি করে বেরিয়েছে। তখন শুরু হয় সোনা ও মাদক চোরাচালান। এমনকী পাকিস্তান থেকে নারী পাচারের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। পাঞ্জাব বা হরিয়ানার যুবক-যুবতীদের মধ্যে মাদক পাচার করার বড় হাত ছিল জয়পালের। চণ্ডীগড়ের বুরারি জেলে রকির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় জয়পালের। রাজস্থানে মাদক ব্যবসা শুরু করে জয়পাল। রকির হয়ে কাজ করতে শুরু করে হ্যাপি। ২০১২ সালে হ্যাপিকে খুন করে শেরা। তার দু’মাস পর এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় তার। শেরার খবর পুলিশকে দিয়েছিল রকির দলের সদস্যরা। এই শেরা হল জাতীয়স্তরের হ্যামার থ্রোয়ার।
জয়পাল সিং ভুল্লার ছিল রীতিমতো স্পোর্টসম্যান। বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছে সে। নিজে পুলিশ হতে পারেনি। কিন্তু বাবার খাকি উর্দি পরে অপরাধে হাত পাকায় সে। মুম্বই পুলিশের হেড কনস্টেবলের ছেলে দাউদ ইব্রাহিমের মতো টাকার লোভে পাঞ্জাব, হরিয়ানার গ্যাংস্টার হয়ে ওঠে জয়পাল। ২০১৬ সালে শত্রু রকিকে খুন করে অপরাধের বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠে জয়পাল। তার সঙ্গে ছিল ভাই অমৃতপাল, গগনদীপ, ভিকি গউন্ডার, প্রেমা লাহোরিয়া, বলজিন্দর সিং ওরফে বাব্বি, যশপ্রীত সিং ওরফে জসসি, সাহাউলির দর্শন সিং। তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর খুন, খুনের চেষ্টার মামলা রয়েছে। ২০১৭ সালে চণ্ডীগড়ের কাছে বানুরের একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ক্যাশ ভ্যান থেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ডাকাতি করেছিল জয়পাল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ কিলো সোনা লুঠের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। পাঞ্জাব পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় ভিকি গাউন্ডার ও প্রেমা লাহোরিয়ার। তখন তিন সঙ্গী বলজিন্দর, যশপ্রীত এবং দর্শনকে নিয়ে ঘটিয়ে চলে সংগঠিত অপরাধ। তারপর আরও এক কুখ্যাত অপরাধী লাকির সঙ্গে পরিচয় হয় দর্শন এবং বলজিন্দরের। পরে জয়পাল ও যশপ্রীতের সঙ্গেও পরিচয় হয় তার। খুন ও অপহরণের অভিযুক্ত লাকি জয়পালের গ্যাংয়ের সঙ্গে শুরু করে চোরাচালান।
এরপরই তার মাথার দাম ১০ লক্ষ টাকা ঘোষণা হয়। যশপ্রীতের সহযোগী জসসির মাথার দাম ছিল ৫ লক্ষ টাকা। জয়পাল ও তার সঙ্গীরা দুই এএসআই ভগবান সিং ও দলবিন্দরজিৎ সিংকে গুলি করে। তাঁদের গলা ও কোমরের কাছে গুলি লাগে। গুলিতে আহত হন আরও এক পুলিশকর্মী। গুলি চালাতে চালাতেই জয়পাল ও তার সঙ্গীরা পুলিশের অস্ত্র নিয়ে পালায়। জগরাঁওয়ের কাছে একটি গ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত তারা। এই ঘটনার পর আলাদা হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যায় তারা।
লুধিয়ানায় কুখ্যাত এক অপরাধী ভরত কুমার তাদের জন্য এই রাজ্যের ভুয়ো নম্বর প্লেটের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়। সে তাদের কলকাতার বাসিন্দা এক আত্মীয়ের কাছে পাঠায়। ওই আত্মীয়ই সাপুরজিতে ফ্ল্যাট ভাড়ার ব্যবস্থা করে। সেই আত্মীয়কেও পুলিশ খুঁজছে। সেই সূত্র ধরেই পাঞ্জাব পুলিশের একটি টিম কলকাতায় আসে। তাদের সহযোগিতায় রাজ্য এসটিএফের টিম নিউটাউনে গিয়ে ফ্ল্যাটটি শনাক্ত করে। তবে বুধবার আর পালাতে পারল না জয়পাল। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হল তার।