পশ্চিমবঙ্গে তবলিগি জামাত ফেরত ২০০ জনেরও বেশি মানুষ রয়েছেন কোয়ারেনটাইনে। তাঁদের রাজারহাটের হজ টাওয়ারে কোয়ারেনটাইনে রাখা হয়েছে। গত ১০ দিন ধরে কোয়ারেনটাইনে রয়েছেন তাঁরা। জনমানসে আতঙ্ক রুখতে প্রশাসন অত্যন্ত সন্তর্পণে তাঁদের চিহ্নিত করে কোয়ারেনটাইনে পাঠিয়েছেন। মঙ্গলবার নবান্নে বসে নিজের চিহ্নিত করে দেওয়া ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন’-এর বুধবার ৬ মিনিট ধরে জবাবে একথা জানালেন মমতা। সঙ্গে তাঁর দাবি, না জেনে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে কিছু সংবাদমাধ্যম।
মঙ্গলবার নবান্নের সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এক সাংবাদিক জানতে চান, নিজামুদ্দিনের তবলিগি জামাত ফেরত কতজন কোয়ারেনটাইনে রয়েছেন? প্রশ্ন শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন মমতা। বলেন, ‘এই সব সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন আমাকে করবেন না।’ বুধবার যদিও নিজে থেকেই ৬ মিনিট ধরে সেই ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন’-এর জবাব দিলেন তিনি।
এদিন মমতা বলেন, ‘কেউ কেউ ভ্রান্তিকর নিউজও দিচ্ছেন রিগার্ডিং নিজামুদ্দিনে যারা গিয়েছিল তাদের সম্বন্ধে। আমি আগেও বলেছি যে বিদেশমন্ত্রক রাজ্যের হাতে থাকে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও রাজ্যের হাতে থাকে না। এই ২টোই সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের হাতে। নিজামুদ্দিনে অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছিল, এটা অ্যালাও করেছিল বলে হয়েছিল। প্রথম থেকে অ্যাকশন নিলে.... আমি এখন রাজনৈতিক উত্তরের মধ্যে যেতে চাই না। তাই এখন আমি ডিটেইলস নিয়ে আলোচনা করছি না।‘
রাজ্য প্রশাসন যে এব্যাপারে সময় মতো উপযুক্ত পদক্ষেপ করেছে তা বোঝাতে মমতা বলেন, ‘আমি এটুকু বলতে চাই যে আমাদের কাছ যখন খবর এসেছিল যে এখান থেকেও অনেকে গেছে। তার পর আমাদের প্রশাসন খুব কোয়াইটলি, এবং আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন... আপনারা অনেকে জানেন না, আপনাদের নলেজে নেই অনেকের, এবং কেউ কেউ এটা নিয়ে উলটো পালটা মন্তব্যও করছেন। কেউ কেউ সাম্পোদায়িক কথাও বলছেন।‘
মহামারি যে জাত-ধর্ম দেখে হয় না, এদিন তাও ব্যাখ্যা করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, যদি কোনও রোগ মহামারি হয় সেই মহামারিতে কিন্তু কোনও কাস্ট দেখে, কোনও রিলিজিয়াস দেখে বা কোনও কমিউনিটি দেখে নয়, সবার ঘরেই ঢুকে যায়। বন্যার জল যেমন কোন বাড়িটায় ঢুকবে আর কোন বাড়িটায় ঢুকবে না এটা ভাবার অবকাশ দেয় না, আগুন লাগলে পাশাপাশি আগুনটা যে সবার বাড়িতেই লাগে, এটা নিশ্চই আপনারা জানেন। তেমনই মহামারিতে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে শিখ, কে খ্রিস্টান, কে ভাই, কে বোন, কে ছোট, কে বড়, কে সাদা, কে কালো, আজ কিন্তু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। কোনও রাষ্ট্র বলতে পারবে না, আমি নেই। অনেক রাষ্ট্রে তো প্রচুর মানুষ মারাও গিয়েছে।‘
নিজামুদ্দিনের জামাতকে যে করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী করা উচিত নয় তা বোঝাতে মমতা বলেন, ‘এটা শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাস থেকে। ইন্ডিয়াতেও জানুয়ারি মাসের লাস্ট উইকেই প্রথম কেস কেরালাতে হয়। তার আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এরোগ ছড়িয়েছে। আর আমরা তো জানতাম না ভারতবর্ষে এতটা ছড়াবে। ভারত সরকার ২৪ মার্চ থেকে এখানে লকডাউন ঘোষণা করেছে। তার আগে ১৩ মার্চ নিজামুদ্দিনের প্রোগ্রাম হয়েছে। তার আগে আপনারা জানেন দিল্লিতে বড় দাঙ্গাও হয়েছিল। অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তখন একটা মধ্যপ্রদেশের বিপর্যয়ও চলছিল। কাজেই আমাদের কাছে খবর না আসলে ডিটেইলস। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে কোন প্যাসেঞ্জার নামল, রাজ্য পুলিশকে খবরটা না দিলে আমরা জানতে পারি না। বিদেশিরা যখন এসেছেন এদেশে তখন নিশ্চই তাঁদের পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স নিয়ে এসেছেন। সেটা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের আন্ডারে, আমাদের আন্ডারে নয়। তা সত্বেও আমরা আমাদের দায়িত্ব কিন্তু পালন করেছি।‘
এর পর পরিসংখ্যান দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘রোগ কখনও হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান দেখে হয় না। আমাদের কাছে ইনফরমেশন আসার সাথে সাথেই, মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে খুব কোয়াইটলি আমরা যে কাজটা করেছি, আজকে আপনাদের আমি বলছি শুনে রাখুন, আজ থেকে ১০-১২ দিন আগে, আমরা ১০৮ জন বিদেশিকে যারা এই প্রোগ্রামে ছিলেন তাদের কেউ মালয়েশিয়া থেকে, কেউ ইন্দোনেশিয়া থেকে কেউ থাইল্যান্ড থেকে, কেউ মায়ানমার থেকে, তাদের আমরা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে গিয়েছি। ১০ দিন ধরে তারা কোয়ারেনটাইন সেন্টারেই রয়েছে। এবং হেল্থ ডিপার্টমেন্টের মনিটরিংয়ে। আর বেঙ্গল থেকে যারা গেছিল তাদের মধ্যে ৬৯ জন ওদের সাথে আছে। মোট ১৭৭ জন যারা এই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তারা যেমন আছেন কোয়ারেনটাইনে, তেমন সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন ওপর আমাদের রাজারহাটে হজ টাওয়ারেও আমরা রেখেছি কোয়ারেনটাইন সেন্টার করে। হজ কমিটি থেকে দিতে চেয়েছে জায়গাটা।
মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, ‘হেলথ মিনিস্টি ডিরেক্ট এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রোজ মনিটরিং করছে। যারা বলে বেড়াচ্ছেন এই হল না, সেই হল না, নিজেরাই করিয়েছেন আবার বলে বেড়াচ্ছেন, তাদের বলি দয়া করে ফিগার না জেনে, ফ্যাক্টস না জেনে, অনেক কিছু সরকারে থাকতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারকেও করতে হয়, রাজ্য সরকারকেও করতে হয়। কিছু সিক্রেসি মেইনটেন করতে হয়। আমি যদি দেখি কোনও সংবাদ, একটা সমাজে প্যানিক তৈরি করতে পারে আমি সেদিকে কেন যাব? আমি চেষ্টা করব যে সংবাদ মানবিক ভাবে, মানুষকে সাহায্য করবে, এবং মানুষকে ভাল করবে।‘
প্রশ্ন হল, সাংবাদিকের প্রশ্নকে ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা না দিয়ে এই কথাগুলো গত কাল বলতে কী সমস্যা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর?