ঘড়িতে দুপুর ২টো। নারদ মামলায় জামিনের শুনানি শুরু হয়। কলকাতা হাইকোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের সামনে সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহেতা এই মামলা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সওয়াল করলেন। আর তাতেই তেতে উঠল শুনানি। তুষার মেহেতার দাবি, তিনি জামিন বা স্থানান্তকরণ নিয়ে তরজা করছেন না। এই মামলার প্রেক্ষিত বৃহত্তর বলে আইনের শাসন নিয়ে কথা বলছেন। বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতিদের মধ্যে রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্ৰধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল, বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন, বিচারপতি সৌমেন সেন এবং বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।
এদিন তুষার মেহেতা শুনানির শুরুতে সওয়াল করেন, ‘আমি মহামান্য আদালতকে অনুরোধ করব তারা যেন গ্রেফতারির বিষয়টিকে এক মুহূর্ত ভুলে যান। আমার প্রশ্ন, যেভাবে জামিন দেওয়া হয়েছিল তা ঠিক কিনা? ধরে নিচ্ছি গ্রেফতার করা অনৈতিক ছিল। কিন্তু যেভাবে বিচারব্যবস্থায় নাক গলানো হল তা কি বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জনতার বিশ্বাসে প্রভাব পড়বে না। আমরা চাইছি আলোচনা হোক আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে। আমার মতকে রাজনৈতিক ভাববেন না। এটা আটকাতে না পারলে অনেক রাজ্যেই ঘটবে।’
এই কথা শুনে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘দেশে এর আগেও জনরোষের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আপনি যদি দেখাতে না পারেন যে সংশ্লিষ্ট বিচারপতি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, ততক্ষণ এই নিয়ে বাদানুবাদ গঠনমূলক নয়।’ তারপরই বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে এই ধরনের কাজে করে। তবে আবেগ যেমনই হোক, আইন তা কখনই অনুমোদন করে না। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ বিচারকে প্রভাবিত করে এমনটা মনে করার কারণ নেই।’
এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘চারটি আবেদন জমা পডে়ছে অভিযুক্তদের জামিন চেয়ে। আপনার আবেদনটি স্থানান্তকরণের। আমার ধারণা, জামিন দেওয়া হবে, না হবে না সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণই এখন ন্যায়সঙ্গত।’ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহেতা গর্জে উঠে বলেন, ‘তাহলে এই ধরনের উন্মত্ততা পবিত্র। আমি তো ন্যায়ালয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি!’ তখনই বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আপনি সওয়াল করতেই পারেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না বিচারের ভার পাঁচ বিচারপতির উপর ন্যস্ত। তখন ঢোঁক গিলে তুষার মেহেতা বলেন, ‘আমাক ভুল বুঝবেন না। সাংবিধানিক প্রধানরা সিবিআই অফিসে গিয়েছে অভিযুক্তের পক্ষে, তাই আমি বলছি এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। গণতন্ত্রে এটা হয় না। গ্রেফতার বেআইনি হলে আদালতে যাওয়া যেত। কল্যাণের বাক্যবাণ-
এই কথা শুনে ক্ষেপে যান আইনজীবী কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘সলিসিটার জেনারেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা চালিয়ে যাবেন আমাদের কথা শোনা হবে না এমনটা হতে পারে না। এটা ন্যায়কাঠামোকে লঙ্ঘন করা চলছে। পাঁচদিন ধরে কথাবার্তা চলবে আর অভিযুক্তরা হেফাজতে থাকবেন এটা তো চলতে পারে না। এটা স্বাধীনতার প্রশ্ন। আমাদের আবেদন এক কোণায় পড়ে থাকতে পারে না। সাইক্লোন হয়ে গেল কাজ করতে পারলেন না ফিরহাদ হাকিম। ভুগছে সাধারণ মানুষ।
এই কথা শুনে প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল বলেন, ‘আমরা সবাই কিন্তু লকডাউনে গৃহবন্দি।’ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এখানে যা চলছে তাতে আমি ব্যথিত। এটা ক্লাসরুম নয়। ৪০ বছরে এমন দেখিনি।’ অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন, ‘কল্যাণ যা বলছেন আমি তা সমর্থন করছি। আর হ্যাঁ জনরোষ জামিন বাতিলের কারণ হতে পারে না। তুষার মেহেতা যেসব সুস্বাদু প্রশ্ন তুলছেন তা পরেও আলোচনা হতে পারে।মেহেতা জামিন ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলছেন। জামিনের দরজাটা তিনি বন্ধই রাখতে চাইছেন।’
এই মন্তব্যের জেরে বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘না বিষয়টি শুধুই জামিন কি জামিন নয় তাতে আটকে নেই। জামিন হলে গোটা বিষয়টিই খারিজ হয়ে যায়।’ তখন তুষার মেহেতা বলে ওঠেন, ‘মামলা অন্যত্র গেলে সব অভিযুক্তই পক্ষ।’ পাল্টা কড়া ভাষায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সওয়াল করেন, ‘শুভেন্দু অধিকারী–মুকুল রায় কেন নন? বিজেপিতে যোগ দিলেন বলে?’