ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল বা জাতীয় পরিবেশ আদালত বৃহস্পতিবার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে কোনওমতেই রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো করা যাবে না। সম্প্রতি বিরোধীরা অভিযোগ তোলেন যে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুভাষীদের ভোটের জন্য বিভিন্নরকম চেষ্টা করে চলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যেই দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো পালনে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতে আর্জি জানায় কেএমডিএ। সেই আর্জি খারিজ করেছে আদালত।
যদিও বৃহস্পতিবার দুপুরেই রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, এবার রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো করাতে চেয়ে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। জানা গিয়েছে, সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা বিবেচনা করে শুধুমাত্র একদিনের জন্য ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার জন্য আবেদন জানায় কেএমডিএ। একইসঙ্গে তাদের পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়, দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস বলে পরিচিত রবীন্দ্র সরোবরের কৃত্রিম হ্রদে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো করাতে একদিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার আর্জির কথা শুনে বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘নগরোন্নয়নমন্ত্রী একদিনের জন্য ছাড় দেওয়ার কথা বলছেন। আমি তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইবো, অক্সিজেন ছাড়া এক মিনিটের জন্য কি কেউ কখনও বাঁচতে পারবে?’ রাজ্যের পরিবেশবিদ ও সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের আন্দোলনে সাড়া দিয়েই ২০১৮ সালে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জাতীয় পরিবেশ আদালত। আর তার নেপথ্যে ছিলেন প্রখ্যাত পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত।
মজার ব্যাপার হল, অধিকাংশ হিন্দুভাষী রাজ্যবাসী দ্বারা সমর্থিত বিজেপি তৃণমূলের এই উদ্যোগকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন জানিয়েছে। বিজেপি–র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহার কথায়, ‘পুজোপাঠ করা মানুষের মৌলিক অধিকার। জলে ফুল–মালা ফেলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকতে পারে তবে কেউ পুরোপুরি পুজোর আচার–বিচার নিষিদ্ধ করতে পারে না।’
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছে কংগ্রেস। তাদের মতে, নিজের দলকে ভোট পাইয়ে দিতে ধর্মীয় উৎসবগুলিকে ব্যবহার করছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার উৎসবগুলিকে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। বিহারি লোকজন কি তাঁকে কখনও বলেছেন যে, রবীন্দ্র সরোবরের জল দূষিত করার অনুমতি না দিলে তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেবে না? নিশ্চয়ই এমন বলেনি। একইভাবে, মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও তাঁকে কখনও বলেনি যে মহরমের শোভাযাত্রার জন্য দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন বন্ধ রাখতে হবে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগুলি জেনেশুনেই করে থাকেন। তিনি মনে করেন, এ সব করলে মুসলিম ও বিহারি ভোট পেতে তাঁর সুবিধা হবে।’
উল্লেখ্য, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ২০১৯–এর নভেম্বরে ছটপুজোর সময় বন্ধ গেট জোর করে খুলে সরোবরে ঢুকে পড়ে বহু মানুষ। সঙ্গে নিয়ে আসে ঢোলতাসা, বাজনা। ফাটানো হয় দেদার শব্দবাজি। সে বার কলকাতা এবং শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় পুকুর বা জলাশয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ছটপুজো করার সুষ্ঠু আয়োজন করা সত্ত্বেও কীভাবে সকলে ভিড় করে রবীন্দ্র সরোবরে। এই ঘটনাকে ঘিরে সে বার মারাত্মক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরোবরের বাসিন্দা এক কচ্ছপের দেহ ভেসে ওঠার পরে বিতর্ক আরও বাড়ে। মাছের মড়কও দেখা দেয়।
১৯২ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত রবীন্দ্র সরোবরে ৭ হাজারেরও বেশি গাছ রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক আমফান ঘূর্ণিঝড়ে এর অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবুজ ঘেরা এই কৃত্রিম হ্রদ ও গাছগাছালি পাখিদের স্বর্গরাজ্য। প্রায় ২০০ প্রজাতির পশুপাখি এখানে বাস করে। বছরের বিভিন্ন সময়ে সরোবরে ভিড় করে পরিযায়ী পাখিরা। যাদের দেখতে দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পক্ষীপ্রেমী মানুষজন। এর বিশাল ঝিলে বিভিন্ন প্রকারের মাছও রয়েছে।