আরজি কর কাণ্ডের পর এবছরের মতো দুর্গাপুজো বন্ধ রাখার জন্য তথাকথিত যে ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা কি একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল? নাকি এর নেপথ্যে ছিল অবাঙালি মনোভাব?
এই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে। কারণ, রাজ্য সরকারের হিসাব বলছে, জেলাগুলিতে এবছর প্রায় ৪২ হাজার বারোয়ারি দুর্গাপুজো হচ্ছে। তাদের মধ্যে সরকারি অনুদান নিতে অস্বীকার করেছে মাত্র ৫৯টি পুজো! যা কিনা শতাংশের হিসাবেই আসে না।
নবান্নের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের হাতে 'দুর্গাপুজোয় রাজ্য সরকারি অনুদান' সংক্রান্ত যে তথ্যাবলী এসে পৌঁছেছে, সেই তথ্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সেখানে দেখা যাচ্ছে, যে পুজো কমিটিগুলি অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছে, সেগুলির অধিকাংশই একটি নির্দিষ্ট এলাকার।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, যে ৫৯টি পুজো কমিটি এবছর রাজ্য সরকারের অনুদান নেয়নি, তাদের মধ্যে ২৫টিই বিধাননগর পুলিশ জেলার অন্তর্গত! লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই এলাকার একটা বড় অংশে মূলত ধনীরা বসবাস করেন এবং তাঁদের অধিকাংশই আবার আদতে অবাঙালি।
সূত্রের দাবি, এই বড়লোক অবাঙালিদের উপর বিজেপির প্রভাব রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি কেবলমাত্র গেরুয়া রাজনীতির প্রভাবেই এখানকার পুজো কমিটিগুলি রাজ্য সরকারের অনুদান নেয়নি? প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক নির্বাচনেও এই এলাকায় ভালো ফল করেছে বিজেপি।
উলটো দিকে, সারা রাজ্যে এমন একাধিক পুলিশ জেলা রয়েছে, যেখানে একটিও পুজো কমিটি রাজ্য সরকারের অনুদান নিতে অস্বীকার করেনি। এগুলি হল - বনগাঁ, বসিরহাট, ডায়মন্ড হারবার, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া গ্রামীণ, জঙ্গিপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি গ্রামীণ, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর, দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার। এমনকী, বীরভূম জেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে।
অর্থাৎ, পাহাড় থেকে সমতল, জঙ্গল মহল থেকে থেকে লাল মাটির জেলা - কোনও জায়গাতেই পুজোয় সরকারি অনুদান গ্রহণ করতে উদ্যোক্তারা অনীহা দেখাননি।
আরও একটি লক্ষ্মণীয় বিষয় হল, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা, অর্থাৎ পূর্ব মেদিনীপুরেও প্রায় ১৩০০ পুজো কমিটি অনুদান গ্রহণ করেছে। সরকারি আর্থিক সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করেছে মাত্রটি চারটি পুজো কমিটি।
এই পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে ওয়াকিবহাল মহল যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাতে রাজ্যের শাসক শিবিরের স্বস্তি অবশ্যই কিছুটা বাড়বে। কারণ, প্রথম থেকেই নানা মহলে একটা দাবি উঠছিল যে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ মূলত শহরকেন্দ্রিক। দুর্গাপুজোয় সরকারি অনুদান গ্রহণের তথ্য খতিয়ে দেখলে সেই দাবি অনেকাংশেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
এতে ধরে নেওয়া যেতে পারে, এখনও পর্যন্ত গ্রামীণস্তরে, অন্তত আরজি কর কাণ্ডের জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক কমেনি। এটা তাদের বড় স্বস্তি তো বটেই।
পাশাপাশি, বিশেষ একটি শ্রেণি প্রতিবাদের আড়ালে বাঙালির আবেগে আঘাত হানতে চেয়েছিল বলেও অভিযোগ উঠছে। তা না হলে বেছে বেছে কেবলমাত্র দুর্গাপুজো বন্ধ করার কথাই কেন বলা হয়েছিল? যেখানে অন্যান্য পুজো, পার্বণ কিন্তু চলছিল।
তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, নবান্নের তরফে সামনে আসা পুজোর অনুদানের এই হিসাব আরও একবার প্রমাণ করে দিল, বাঙালি যেমন প্রয়োজনে ঐতিহাসিক প্রতিবাদে সামিল হতে পারে, তেমনই সেই প্রতিবাদের আগুন বুকে নিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যও রক্ষা করতে জানে।