নয় নয় করে ন’বছর কেটেছে রাজ্যপাটে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে দলকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। একাধিক নির্বাচনে তাঁর মুখকে সামনে রেখেই বিপুল ভোটে জিতেছে তৃণমূল। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা এখন শুনছেন না অনেকেই। বুধবারের সর্বদল বৈঠকের পর কার্যত একথা স্বীকার করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০৬ – ২০১১য় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে বিরোধী আন্দোলনের ঝড় তুলেছিলেন মমতা ক্ষমতায় আসার পর তা পরিণত হয়েছে কেন্দ্র বিরোধিতায়। চলতি প্রথার বাইরে গিয়ে নানা ভাবে রাজ্যশাসন করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাতে একদিকে যেমন উপকৃত হয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তেমনই ক্ষুব্ধও হয়েছেন কেউ কেউ। আর বিজেপির দিকে জনসমর্থনের ভিত্তি কিছুটা ঘুরতেই রীতিমতো বিদ্রোহী হয়েছেন তাঁরা।
শুরু করা যাক ত্রাণ বিলিতে দুর্নীতি নিয়ে। লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। বলেছিলেন, ‘কেউ কাটমানি নিয়ে থাকলে ফেরত দিতে হবে।’ তার পর বাড়িতে টেকা মুশকিল হয়ে গিয়েছিল বহু তৃণমূল নেতার। কিন্তু তৃণমূলে দুর্নীতি থামেনি। এদিন আমফানের ত্রাণে দুর্নীতি নিয়ে ফের ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’-র সুরে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, আমফানের ত্রাণে স্বজনপোষণ মানবে না সরকার। তা সে যে দলই করে থাকুক না কেন। দলীয় কর্মীদের অবাধ্যতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে তাদের শায়েস্তা করতে বিডিও- জেলাশাসককে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা সংশোধনের অধিকার দিতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে।
বাসমালিকরাও তাঁর কথা শুনছেন না বলে এদিন কার্যত মেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘অনেকে বলছেন ভাড়া না বাড়ালে বাস নামাবো না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ভাড়া কী করে বাড়াবো? এখন বাসমালিকদের মানবিকতার খাতিরে বাস চালানো উচিত। মুনাফার জন্য নয়।’
অথচ ক্ষমতায় আসার আগে এই বাসমালিকরা ছিলেন মমতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাম জমানায় আদালতের নির্দেশে ১৫ বছরের পুরনো বাস বাতিলের প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন বাসমালিকরা। সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার জেরে বেশ কয়েকদিন চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল কলকাতার মানুষকে। ক্ষমতায় এসে বাসমালিকদের সংগঠনের নেতা স্বর্ণকমল সাহাকে বিধায়ক করেছেন মমতা। কিন্তু বাসমালিকরা আর শুনছেন না মুখ্যমন্ত্রীর কথা।
সরকারের কথা শুনছেন না সরকারি ডাক্তারবাবুরাও। তাই হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরালে বিভাগীয় পদক্ষেপের হুমকি দিতে হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরকে।
একই পরিস্থিতি বেসরকারি হাসপাতালেও। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের জারি করা চিকিৎসা সংক্রান্ত নির্দেশিকা তাঁরা মানছে না বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। ফের একবার নির্দেশিকা জারি করতে প্রশাসনিক আধিকারিকদের নির্দেশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ হবে কি? বেসরকারি হাসপাতালগুলির ওপর চাপ বাড়াতে ক্ষমতায় এসে হেলথ রেগুলেটরি কমিশন বানিয়েছেন মমতা। IMA-র মতো সংস্থা থাকতে রাজ্যের তরফে কমিশন তৈরি মোটেও ভালভাবে নেয়নি বেসরকারি হাসপাতালগুলি। তাই সুযোগ পেয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার পথে হেঁটেছে তারাও।
বিশেষজ্ঞদের মতে নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় এসে দলীয় কর্মীদের বিশৃঙ্খলাকে প্রচ্ছন্নে নানা ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। অধ্যাপক নিগ্রহকে বলেছেন, ‘ছোট ছেলেদের কাজ’। বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির স্বচ্ছ্ব ভাবে তদন্ত করাননি তিনি। তাতেই লুঠপাটকে অধিকার বলে ভাবতে শুরু করেছেন তৃণমূলকর্মীরা। যার চরম রূপ দেখা যাচ্ছে আমফানের ক্ষতিপূরণে। আর শিরে সংক্রান্তি বুঝে এখন দলীয় পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে তৃণমূল।
একই পরিস্থিতি বাসমালিকদের ক্ষেত্রেও। বেসরকারি বাস শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলির চাপ রয়েছে তাঁদের ওপর। কিন্তু অর্থনীতির হিসাব উলটে ক্ষতি সয়ে তাদের পক্ষে বাস চালানো অসম্ভব। সেকথা মানতেই হবে সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি জল উঁচু বললেই যে আর জল উঁচু হবে না, তা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে মমতার।