আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎস ধর্ষণ ও খুনের মামলায় গতকালই সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা করেন শিয়ালদা আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস। নিজের ১৭২ পাতার নির্দেশনামায় নিজের রায়ের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন বিচারক। এরই সঙ্গে তিনি বেশ কিছু পর্যবেক্ষণও করেছেন। এর মধ্যে পুলিশ এবং আরজি কর কর্তৃপক্ষকে নিয়েও তাঁর পর্যবেক্ষণ আছে। আরজি কর কাণ্ডে প্রথম থেকেই শাসকদল জোর গলায় বসে এসেছিল, পুলিশই সঞ্জয় রায়কে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধরেছে। এই আবহে পুলিশি তদন্ত নিয়ে ওঠা প্রশ্ন 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'। গতকাল রায় প্রকাশের পরও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'আক্ষেপ' করে বলেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে জোর করে মামলা সরিয়ে নিয়ে তা দেওয়া হয় সিবিআইয়ের হাতে। তবে বিচারক অনির্বাণ দাস নিজের নির্দেশনামায় উল্লেখ করলেন আরজি কর কাণ্ডে কোথায় খামতি ছিল পুলিশি তদন্তে। এমনকী আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোথায় গাফিলতি করেছিল, তা নিয়েও পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি।
বিচারক দাসের নির্দেশনামায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, খুনের ঘটনা সামনে আসার পর এফআইআর থেকেই পুলিশি তদন্তে খামতি থেকেছে। টালা থানার এসআই সুব্রত চট্টোপাধ্যায় নিয়ম বহির্ভূত কাজ করেছিলেন। এদিকে লালবাজারের তৎকালীন উইমেন্স গ্রিভ্যান্স সেলের অতিরিক্ত ওসি রূপালী মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকার সমালোচনা রয়েছে আরজি কর মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে। এদিকে ঘটনা সামনে আসার পর আরজি কর হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেছেন বিচারক অনির্বাণ দাস। বিচারক প্রশ্ন তুলেছে, কেন ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হয়নি।
পর্যবেক্ষণে বিচারক অনির্বাণ দাস বলেন, আরজি কর কাণ্ডে এফআইআর হয় রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে। তবে সেই নথিতে সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাত ১০টা ১০ মিনিট। যদিও এসআই সুব্রত রাত ১০টা ১০ মিনিটে থানায় ছিলেন না। এই আবহে এসআই-এর এই কাজকে 'অবৈধ' আখ্যা দিয়েছেন বিচারক। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, 'কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এসআই নিজের অবৈধ কাজকর্মের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা শুনে আমি স্তম্ভিত।' এদিকে বিচারক প্রশ্ন তোলেন, কেন নির্যাতিতার পরিবারকে ৯ অগস্ট সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়?
এদিকে নির্দেশনামায় সঞ্জয়ের ফোন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে বিচারকের। তিনি জানান, ৯ অগস্ট অভিযুক্তের ফোন নিয়ে টালা থানায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। লালবাজারের তৎকালীন উইমেন্স গ্রিভ্যান্স সেলের অতিরিক্ত ওসি রূপালী সেই কাজটি করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে নির্দেশনামায়। এই আবহে বিচারকের প্রশ্ন, তিনি কেন সেই কাজটি করেছিলেন? যদিও তিনি জানিয়েছেন, সেই সময় ফোনে কোনও কারসাজি হয়েছে বলে প্রমাণ মেলেনি। তবে এর সঙ্গে বিচারক এও জানান, রূপালী এর পরিপ্রেক্ষিতে যে যুক্তি দিয়েছেন, তা খুবই দুর্বল।
এদিকে সন্দীপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিচারক জানিয়েছেন, ঘটনার দিন সিনিয়র চিকিৎসক সুমিত রায় তপাদার মহিলার দেহ দেখে বুঝেছিলেন যে তাঁকে খুন করা হয়। তখন তিনি বিষয়টি চেস্ট মেডিসিন বিভাগের প্রধানকে জানিয়েছিলেন। চেস্ট মেডিসিনের প্রধান তখন ডঃ সুমিতকে বলেছিলেন হাসপাতাল সুপার এবং অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানাতে। ততক্ষণে সুমিত নার্সদের বলেন যাতে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। এদিকে সুমিত যখন তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ এবং অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ফোন করেন, তাঁরা ফোন তোলেননি। সন্দীপ পরে ফোন করে দেহ মর্গে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুমিত অবশ্য সেই আদেশ পালন করেননি। তবে সন্দীপ কেন দেহ মর্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারক।
এদিকে নির্দেশনামা অনুযায়ী, ঘটনার দিন হাসপাতালে কর্মরত থাকা সহকারী সুপার (নন মেডিক্যাল) সুচরিতা নির্যাতিতার পরিবারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের মেয়ের শরীর ভালো নেই। পরে সুচরিতা নির্যআতিতার বাবাকে বলেছিলেন, তাঁর মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেই সময় সুচরিতার সামনে ছিলেন সুমিত। এর প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। সুচিতার এই কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিচারক। এদিকে বিচারক নিজের নির্দেশনামায় জানান, মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হওয়ার পর একটি বৈঠক ডেকেছিলেন সন্দীপ। সেই বৈঠকে সুমিতকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বৈঠকে ঢুকতে পারেননি। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই আবহে কেন সেই বৈঠকের বয়ান পুলিশ নথিবদ্ধ করেনি, তা নিয়ে বিচারক প্রশ্ন তুলেছেন।