Soumitra Biswas RG Kar Case: আরজি কর কাণ্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন সিনিয়র চিকিৎসকরাও। আর এই সিনিয়র চিকিৎসকদের অন্যতম সুবর্ণ গোস্বামী। ৯ অগস্ট থেকেই এই ঘটনার প্রতিবাদের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। এবার তাঁর নামেই উঠল গুরুতর অভিযোগ। ২০০১ সালে আরজি করের বেলগাছিয়া হোস্টেলে আত্মহত্যা করে এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া সৌমিত্র বিশ্বাস। তৃণমূলের আইটি সেলের তরফে দেবাংশু ভট্টাচার্যের অভিযোগ, এই মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি যোগ ছিল হাসপাতালের এসএফআই সংগঠনের তৎকালীন নেতা সুবর্ণ গোস্বামী (Subarna Goswami)-সহ আরও দুইজনের। ‘দুবে’, ‘গোঁসাই ঠাকুর’ ও ‘ধরবাবু’ নামে পরিচিত তিন নেতার দাপটেই একটি পরিকল্পিত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয় বলে অভিযোগ। সৌমিত্র বিশ্বাসের (Soumitra Biswas) মা সবিতাদেবীর অভিযোগ ছিল ছেলে আরজি করের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে চলা পর্নোগ্রাফিক চক্রের ব্যাপারে জেনে গিয়েছিল। তাঁর ব্যাচের একটি মেয়ের ছবি বিকৃত করা হয়েছিল। সেই কথা মেয়েটিকে জানাতেই চক্রের হোতারা খবর পেয়ে যায়। এর পরেই তাঁকে খুন হতে হয়। প্রথমে পুলিশ ও পরে সিআইডি তদন্ত করে গোটা ঘটনার। খুনের তত্ত্ব প্রমাণ না হলেও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল পর্নোগ্রাফিক চক্রের।
কীভাবে চলত পর্নোগ্রাফিক চক্র?
ইতিমধ্যেই এই অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলেছেন চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর কথায়, আরজি কর (RG Kar Case) আন্দোলনের জেরে শাসক দল বর্তমানে বিব্রত। তাই নানাভাবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁকেও একই কারণে ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিন্তু খুনের অভিযোগের বাইরে আরেকটি মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তা হল পর্নোগ্রাফির চক্রের কারবার। এই বিষয়ে চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী HT বাংলাকে বলেন, ‘চক্রের অস্তিত্ব কখনই ছিল না। সেই সময় এসইউসিআই (SUCI)-র ছাত্র সংগঠন ডিএসও এই কুৎসা ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ। পর্নোগ্রাফির ঘটনায় মূলত তিন-চারজন ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিল। যাদের পরে গ্রেফতার করা হয়। সৌমিত্রর ব্যাচেরই পড়ুয়া ছিল তাঁরা। তাদের মধ্যে একজন মেয়েও ছিল। যাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সে জামিন পেয়ে যায়।’
সিআইডি রিপোর্টে পর্নোগ্রাফির অস্তিত্ব
ঘটনাটির তদন্তভার পরে সিআইডি-কে দেওয়া হয়েছিল। সিআইডি রাজ্য সরকারের অধীনস্থ একটি সংস্থা। ফলে তার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সিআইডি রিপোর্টেও পর্নোগ্রাফির উল্লেখ ছিল। তাদের তৎপরতায় পর্নোগ্রাফি শুটিংয়ের ট্রাইপড, লাইট রিফ্লেক্টারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছিল। রিপোর্টে দাবি করা হয়, যৌনকর্মীদের নিয়ে এসে শুটিং করা হত সেখানে। এতটা সংগঠিতভাবে পর্নোগ্রাফি শুটিং কীভাবে সবার অলক্ষ্যে চলতে পারে সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কেনই বা আগে জানতে পারেনি পুলিশ বা হোস্টেলের অন্যান্যরা বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? এই প্রসঙ্গে তুলে আনা যায় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফকে বলা এক সিআইডি আধিকারিকের একটি বয়ান। ২০০৪ সালের ওই প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিআইডি আধিকারিক জানাচ্ছেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ তদন্তের বিষয়ে সহায়তা করছেন না। তাই বিভিন্ন স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সঙ্গে তারা কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অসহযোগিতা কেন, তাই নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে।
কারা জড়িত ছিল পর্নোগ্রাফিক চক্রে?
পর্নোগ্রাফিক চক্রে তিন-চারজন যারা জড়িত ছিল, তারা কি কোনও রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ ছিল? তা না হলে প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই এই ধরনের অপরাধ চলত কাদের মদতে? এই প্রসঙ্গে সুবর্ণ বলেন, ‘টিএমসিপি-র সমর্থক ছিল বলে জানা গিয়েছিল সেই সময়। কিন্তু সক্রিয় সংগঠন কর্মী ছিল না তাঁরা।’ কীভাবে বলছেন সক্রিয় কর্মী ছিল না? সুবর্ণবাবুর যুক্তি, ‘তেমনটা হলে এসএফআই-এর কাছে খবর থাকত। সাংগঠনিকভাবে এর প্রতিবাদও করা হত। সেই সময় পর্নোগ্রাফিতে টিএমসিপি যোগের অভিযোগও উঠেছিল। তারাও বিষয়টির প্রতিবাদ করে। এসএফআই-ও এই কুৎসার প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল তখনকার শিক্ষক, কর্মীরাও।’ তাহলে পুরো বিষয়টিই চক্রান্ত? সুবর্ণবাবুর কথায়, ‘পুরোটাই চক্রান্ত। টিএমসিপির একদা বন্ধু জোট এসইউসিআই এইসবের পিছনে ছিল। এখনও আবার নতুন করে সেই চক্রান্ত শুরু হয়েছে আরজি কর ঘটনার প্রতিবাদ চাপা দেওয়ার জন্য।’
সবিতাদেবীর তখনকার বক্তব্য
২০০১ সালের ২৫ অগস্ট আরজিকর হাসপাতাল ঘটনাটি ঘটে। ওই বছরের নভেম্বর মাসে এই ঘটনা নিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সবিতা দেবী। সম্মেলনটি আয়োজন করেছিল অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অরগানাইজেশন যা আদতে এসইউসিআই-এর ছাত্র সংগঠন ছিল। সবিতাদেবীর বক্তব্য ছিল, তিনি কারওর শাস্তি চান না। কিন্তু তাঁর ছেলের খুনকে আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছে। তিনি অনুরোধ করেন, একটা খুনকে যেন আত্মহত্যা বলে না চালানো হয়। তৎকালীন এসএফআই নেতাদের বিরুদ্ধেই শুধু অভিযোগ তোলেননি সবিতাদেবী, তাঁর অভিযোগ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধেও। পুলিশ এই খুনকে বারবার আত্মহত্যা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সবিতাদেবীর কথায়, সুবর্ণ গোস্বামী, অরুণাভ ধর ও সৌভিক দুবে সবটাই জানেন।
কী ‘জানেন’ সুবর্ণ গোস্বামী?
সবিতাদেবীর ঠিক এই বয়ানটি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সুবর্ণবাবু HT বাংলাকে জানান, ‘জানেন বলতে, ছেলে যে এসএফআইয়ের কর্মী ছিল সেটা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। এখন এসইউসিআই ও তৃণমূলের আইটি সেল মানুষকে বোঝাতে চাইছে, খুনের ব্য়াপারে আমরা তিনজন জানতাম। অর্থাৎ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। যা সর্বৈব মিথ্যা।’ প্রশ্ন এখানেও রয়ে গিয়েছে। যদি সৌমিত্র এসএফআইয়ের কর্মী হন, এবং তাকে তৃণমূলের তরফে শাসানো হয়ে থাকে, তাহলে তার খবর কি কারও কাছেই ছিল না? কেনই বা পর্নোগ্রাফির বিষয়টি সৌমিত্র বিশ্বাসের মৃত্যুর পর সকলের সামনে এল?
সবিতাদেবী ও সুবর্ণবাবুর বিপরীত বক্তব্য
২০০১ সালের নভেম্বর মাসের সাংবাদিক সম্মেলনে সবিতাদেবীর অভিযোগ অবশ্য টিএমসিপির বিরুদ্ধে মোটেই ছিল না। ছিল এসএফআইয়ের বিরুদ্ধেই। এবং সেই অভিযোগের তালিকায় অন্যতম নাম সুবর্ণ গোস্বামী। সুবর্ণবাবু অবশ্য ফোনে জানান, ‘ছেলেটির মা অভিযোগ করেন টিএমসিপির বিরুদ্ধেই।’
কীভাবে পাওয়া গিয়েছিল সৌমিত্র বিশ্বাসের দেহ?
সৌমিত্র বিশ্বাসের মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সেখানে ছুটে যান সবিতাদেবীর ভাই। সবিতাদেবীর কথায়, ‘ভাই সৌমিত্রের মুখে একটি রুমাল দেখতে পেয়েছিল। ওর গলায় একটি সরু দড়ি বাঁধা ছিল। যা দিয়ে আদতে একজনের আত্মহত্যা করা অসম্ভব। সৌমিত্রর হাতে একটি গভীর ক্ষত পাওয়া গিয়েছিল। সেদিকে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তা পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে যে মেয়েটিকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, সে পরে জামিনের জন্য আবেদন করে। কিন্তু সরকারি আইনজীবী আশ্চর্যজনকভাবে জামিনের বিরোধিতা করেনি।’ কেন বিরোধিতা হল না জামিনের? ক্ষত যদি থেকেই থাকে, কেনই বা পুলিশ সেটি এড়িয়ে গেল? পর্নোগ্রাফিক চক্রের অস্তিত্ব থাকলেও কেন তাঁর মুখ আর কথা বার করা গেল না?
২৩ বছর আগের এই ঘটনাটি নিয়ে ফের তদন্তের দাবি উঠেছে। চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীও পালটা মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এমনকী মানহানির মামলা করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। সুবর্ণবাবুর কথায়, ‘বর্তমান সরকারের হাতেই সিআইডি রিপোর্ট রয়েছে। চাইলেই তারা সেই ফাইল রিওপেন করতে পারে। সেটা না করে আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে।’ আপাতত মৃত্যু না আত্মহত্যা, সংগঠিত পর্নোগ্রাফি চক্র না নিছক ঘটনা— তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছে। যে ধোঁয়াশা ২৩ বছর পরে কাটার সম্ভাবনাও বেশ ক্ষীণ।