হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড। চারিদিকে কাচের বলয় ঘেরা। ভিতরে সার দিয়ে সাজানো শয্যা। সেখানে শুয়ে আছেন করোনা রোগীরা। আর তাঁদের আশেপাশেই হয়ে চলেছে অভিনব প্রয়াস। কোথাও ওয়ার্ডের মধ্যেই ‘ফুল ভলিউমে’ বাজতে থাকা হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছেন, তো কোথাও রবীন্দ্রসঙ্গীতে গলা মিলিয়ে গাইছেন ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’। আবার কোথাও স্টেথো ছেড়ে হাতে গিটার তুলেছেন চিকিৎসকরা।
করোনা রোগীদের মনের মধ্যে জমে থাকা ক্লেশ, আতঙ্ক, হতাশা দূর করতে এভাবেই মোর্চা কাঁধে তুলে নিয়েছেন করোনার প্রথম সারির যোদ্ধারা। এই তিনটি খণ্ডচিত্র বাংলার তিন প্রান্তে ঘটলেও ইতিমধ্যেই চিকিৎসকদের এই অভিনব প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানিয়েছে গোটা রাজ্য। আবার চিকিৎসকদের অভিনব এই প্রচেষ্টায় মুগ্ধ করোনা আক্রান্ত রোগীরাও। মনের সমস্ত হতাশা ঝেড়ে ফেলে মেতে উঠেছেন তাঁদের সঙ্গে।
প্রথম ঘটনাটি কলকাতার উডল্যান্ডস হাসপাতালের। কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় একটি ভিডিও। সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, করোনা ওয়ার্ডের মধ্যেই পিপিই কিট পরিহিত একজন স্বাস্থ্যকর্মী জনপ্রিয় হিন্দি গান ‘নিবোড়া নিবোড়া’—র তালে তাল মিলিয়ে নেচে করোনা রোগীদের মন জয় করেছেন। অজিতকুমার পট্টনায়ক নামের ওই পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর উদ্দাম নাচের সঙ্গত দিলেন ওয়ার্ডে উপস্থিত চিকিৎসক, নার্সরা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, করোনা রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য ফেরাতেই তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, যাতে করোনা রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন। চিকিৎসকদের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, করোনা রোগীরা মৃত্যুভয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে অনেক সময় তাঁরা আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন। যার নজির ইতিমধ্যেই প্রত্যেক্ষ করেছে বাংলা। আবার একা থাকার নিঃসঙ্গতাও ঘিরে ধরছে তাঁদের।রোগীদের মন ভাল থাকলে, অনেক ক্ষেত্রেই তা রোগ প্রতিরোধের চিকিৎসায় সাহায্য করে বলেও মত চিকিৎসা মহলের। যাতে রোগীদের মানসিক বিকাশ ঘটে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, সেজন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
আবার রবিবার সন্ধ্যায় রায়গঞ্জের মিক্কিমেঘা কোভিড হাসপাতালে কবিগুরুর ১৬০ তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় । সেখানে করোনা আক্রান্তরা হতাশার রেশ কাটিয়ে মেতে উঠেন রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের আনন্দে। কেউ গেয়ে উঠলেন ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’। কেউ আবার সুর ধরলেন ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’। রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনে তাঁদের সঙ্গ দিলেন চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা।রায়গঞ্জের মিক্কিমেঘা কোভিড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগে খুশির হাওয়া বইছে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে।
হাসপাতালের নার্সিং ইনচার্জ বাপী বিশ্বাস বলেন, 'হাসপাতালের কর্মীরা প্রত্যেক বছরই কোনও স্কুল বা কলেজ গিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে থাকেন। কিন্তু এবারে পরিস্থিতির নিরিখে এই সিদ্ধান্ত। আর স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যতই পরিষেবা দেওয়া হোক না কেন, যেহেতু তাদের একা থাকতে হয়, সেজন্য মানসিকভাবে করোনা আক্রান্তরা কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করেন। সেজন্যই এই চেষ্টা করা হল।’
অন্য দিকে, করোনা আক্রান্তদের মানসিক যন্ত্রণা কাটাতে অভিনব মিউজিক থেরাপির উদ্যোগ নিয়েছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। তাই সেখানে স্টেথো ছেড়ে হাতে গিটার তুলে নিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন সুপারও।
করোনার প্রথম ঢেউয়েও ঠিক একই রকম উদ্যোগ নিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। কড়া মেজাজ ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন মাইক। গানের কলিতে মন জয় করেছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকা মানুষদের।