রণবীর ভট্টাচার্য
‘শোন, বেশি দেরি করিস না, সন্ধ্যার আগে ফিরিস।’
‘সাতটা বেজে গেছে, কোথায় তুই?’
‘কী দরকার আইপিএল দেখতে যাওয়ার, অত রাতে খেলা শুরু হয়!’
এই সব প্রশ্ন কমবেশি সকলেই শুনতে পেয়েছেন বাড়ির মেয়েদের উদ্দেশ্যে - কখনও বাবা মা, কখনও বা প্রিয়জন বা গুরুজন। তবে ঢের হয়েছে! সব কিছুর সহ্যের সীমা রয়েছে! আরজিকর এর ক্ষেত্রে যেই ভয়ানক ঘটনার কথা জেনে শিউরে উঠেছে সারা দেশ (সারা বিশ্ব বললেও ভুল হবে না), যেখানে তাকে অভয়া/ তিলোত্তমা যেই নামেই সম্বোধন করুন না কেন, সমাজকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে নারী অধিকার, স্বাধীনতা নিয়ে। তাই কিছুটা গণপ্রতিরোধের মত করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলারা, বিভিন্ন বয়স নির্বিশেষে ডাক দিয়েছেন যে সামনের ১৪ই আগষ্ট রাত এগারোটার সময় জমায়েত হবে। এটি কোন ব্রিগেড বা সমাবেশ নয়, এই জমায়েত করবেন মহিলারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পর যে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এরকম জঘন্যতম অপরাধ আর তার এই প্রতিবাদ প্রমাণ করছে এখনও সব শিরদাঁড়া বেঁকে যায়নি।
ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে বিভিন্ন এলাকা - ফেসবুকের টাইমলাইন জুড়ে রয়েছে কলেজ স্ট্রিট, একাডেমি অফ ফাইন আর্টস, যাদবপুর এইট বি, সিঁথির মোড়, ডানলপ খালসা মডেল স্কুল, মালদা ইংলিশ বাজার পোস্ট অফিস মোড়, শিলিগুড়ি দার্জিলিং মোড়, উত্তরপাড়া কলেজ মোড়, মধ্যমগ্রাম চৌমাথা মোড়, হাওড়া মন্দিরতলা, হাওড়া আমতলা,জলপাইগুড়ি সদর হাদপাতাল (পুরনো ভবন, দশতলা নয়), শান্তিপুর ডাকঘর, কোচবিহার দাস ব্রাদার্স মোড়, ইছাপুর - স্টোর বাজার, বর্ধমান কার্জন গেট চত্বর, সোদপুর, বি. টি,রোড মোড়,বেহালা শখের বাজার, ব্যারাকপুর, বালি খাল,সল্টলেক, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়,নাগেরবাজার বাস স্টপ, শ্রীরামপুর পূর্ব, শ্রীরামপুর পশ্চিম, শ্রীরামপুর ই এস আই এর বিপরীতে, চৌতারা, বহরমপুর, বাগুইহাটি,বারাসাত ডাকবাংলো মোড়, রতনপল্লী, বোলপুর, ফালাকাটা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল গেট, নিউটাউন বিশ্ব বাংলা গেট,বাঘা যতীন পার্ক, শিলিগুড়ি কোর্ট মোড়, পঞ্চুর চক, মেদিনীপুর, শিবপুর বি ই কলেজ ফার্স্ট গেট,দমদম চাতাল, নবদ্বীপ, বহরমপুর, ক্যানিং, চন্দননগর, পাতুলিয়া, চৌধুরী মোড়, এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেট সহ বিভিন্ন এলাকা। প্রতিটা ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে #justiceforRGKar আর #stoprapeculture হ্যাশট্যাগ। এই পোস্টগুলোর সঙ্গে অনেক ফোন নাম্বার দেওয়ার হয়েছে, যাতে জমায়েতের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলে কথা বলে নেওয়া যায়।
বিষয়টি সর্বত্র আলোড়ন ফেলেছে এবং শুধু যে সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক হতে চলেছে এমনটাও নয়। তবে মহিলারা রাত জেগে মিছিল করবে শুনে অনেক পুরুষ বা ছেলেই যেভাবে উদ্বিগ্ন, তাতে অনেক মহিলাই সপাটে বলেছেন যে তারা যেন নিজেদের বাড়ির মধ্যে বন্ধ করে, চাবিটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিন। প্রতিবাদ যদি হয়, তাহলে এতটা জোরেই হোক, যাতে কান ঝন ঝন করে ওঠে!
অনেক জায়গাতেই রাতে পর্যাপ্ত আলো থাকে না বা যানবাহন যৎসামান্য। তাই ফেসবুকে ১৪ই আগষ্ট সারা রাত মেট্রো বা লোকাল ট্রেন চালাবার দাবি করেছেন অনেকে।
এগুলো কি সত্যি গিমিক, না কিছু হতে পারে? গত এক মাসে বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সংরক্ষণ নিয়ে আপাতত নিরীহ আন্দোলন শেষ মুহূর্তে মসনদে বদল এনেছে, সেটা ভালো না খারাপ, সেটা অন্য তর্কের দাবি রাখে। এই বাংলা মাতঙ্গিনী হাজরার বাংলা, মা সারদা কিম্বা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বাংলা - তাই হেলাফেলা করলে বা অবহেলা করলে বোধহয় সবচেয়ে বড় ভুল হবে। আর আরজিকর নিয়ে গড়পড়তা মানুষ লজ্জিত, বীতশ্রদ্ধ ও স্তম্ভিত। তাই এই প্রতিবাদ অনেক কিছু হেস্তনেস্ত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে।
অনেক বছর পর মধ্যরাতে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হবে আর সেই সঙ্গে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করার দাবিতে রাজ্য জুড়ে জমায়েত করবেন মহিলারা। হয়তো সত্যিকারের পরিবর্তন দেরিতে হলেও আসছে আমাদের দেশে!
(লেখক অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেছেন। গণমাধ্যম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর। এছাড়া ফার্সি, পর্তুগিজ, সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেন। মতামত ব্যক্তিগত)