'ধর্ষকের গ্রাম'! এই 'অপবাদ' মাথায় নিয়ে আর জীবনযাপন করতে রাজি নন বাঁকুড়ার ছাতনার কুলুডিহির বাসিন্দারা। তাঁদের বিশ্বাস, যে কারণে তাঁদের এই 'অপবাদ' বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেই কারণটিই আসলে মিথ্যা, ভুয়ো। এবার তাই, আর জি কর কাণ্ডের আবহেই, গ্রামের হৃত সম্মান ফেরাতে এবং গ্রামেরই এক বাসিন্দার সঙ্গে হওয়া 'অবিচার'-এর বিচার চাইতে ধনঞ্জয় মামলা পুনরায় শুরু করতে উদ্যোগ শুরু করেছেন তাঁরা।
ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। আদতে ছাতনার কুলুডিহি গ্রামের বাসিন্দা ওই যুবক কর্মসূত্রে থাকতেন কলকাতায়। ভবানীপুরের একটি আবাসনে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন তিনি। ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ সেই আবাসনেই এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয় বলে অভিযোগ।
সেই ঘটনায় প্রথমে ধনঞ্জয়কে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া চলার পর তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। প্রবল বিতর্ক ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০০৪ সালের ১৪ অগস্ট আদালতের সেই রায় কার্যকর করা হয়। ফাঁসি হয় ধনঞ্জয়ের।
ধনঞ্জয়ের পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা আজও মনে করেন, ধনঞ্জয় আসলে এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। ধর্ষিতা ও নিহত ছাত্রী এক প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে ছিল। সেই কারণেই ধনঞ্জয়ের উপর ঘটনার পুরো দায় চাপিয়ে 'আসল অপরাধী'কে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির ২০ বছর পর সেই মামলা পুনরায় শুরু করে নতুনভাবে তদন্ত করাতে চাইছেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি।
ড. চন্দ্রচূড় গোস্বামী ও জীবন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গত সোমবার কলকাতার রবীন্দ্র সদন চত্বরে ধনঞ্জয়ের জন্য সুবিচার চেয়ে ধরনা দেন ধনঞ্জয়ের পরিজনেরা। তাঁরা সকলে মিলে ধনঞ্জয় পুনর্বিচার মঞ্চও তৈরি করেছেন।
ধনঞ্জয় মামলা পুনরায় খোলার (রিওপেন) দাবিতে এই মঞ্চের সদস্যরা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি এবং কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রধান বিচারপতিকে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
গত সোমবার রাজ্যের আইন মন্ত্রী মলয় ঘটকের কাছেও একই মর্মে স্মারকলিপি জমা করেছেন সংশ্লিষ্ট মঞ্চের সদস্যরা। তার ভিত্তিতে মঙ্গলবার থেকেই আইন দফতরের তরফে তৎপরতা শুরু হয়েছে।
দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীর ফাঁসির ২০ বছর পর আবার সেই মামলা শুরু করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবীদের পরামর্শ নিচ্ছে রাজ্যের সরকার পক্ষ।
এর আগে দেশে বা বিদেশে কোথাও এমন ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে কিনা, সেই বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তেমনটা ঘটে থাকলে কোন প্রেক্ষিতে মামলা 'রিওপেন' করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা তা পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন।
এর পাশাপাশি, এই মামলার নথি আলিপুর আদালত থেকে সংগ্রহ করা যায় কিনা এবং মামলার সময় যে আইনজীবীরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা, সেসব নিয়েও রাজ্যের তরফে তৎপরতা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে আর জি কর কাণ্ডের জেরে উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। সেই আবহে আবারও একবার ধনঞ্জয় মামলা নিয়ে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ধনঞ্জয় পুনর্বিচার মঞ্চের সদস্যরা ধনঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য সরাসরি তৎকালীন বাম সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনকেই দায়ী করছেন।
তাঁদের দাবি, মামলা পুনরায় শুরু করে সিবিআই-কে দিয়ে আবারও পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করানো হোক। একমাত্র তাহলেই 'আসল' ঘটনা সামনে আসবে। দুর্নাম ঘুচবে ধনঞ্জয় এবং তাঁর পরিবার ও গ্রামের।