লিন্ডসে স্ট্রিটের ছোট্ট একটি দোকান থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা। যা আজ ছুঁয়ে ফেলেছে পর্বতের শিখর। গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্য। এখন রাস্তাঘাটে এদিক-ওদিক তাকালেই চোখে পড়বেই ‘শ্রীলেদার্স’। যে ব্র্যান্ডকে সাদরে গ্রহণ করেছে আপামর বাঙালি। সেই ব্র্যান্ড আজ বাঙালির এতটাই নিজস্ব হয়ে উঠেছে যে দুর্গাপুজোর আগমনী বার্তাও বহন করে নিয়ে আসছে। শ্রীলেদার্সের শাখার সামনে লম্বা লাইনটা না দেখলে যেন মনেই হয় না যে পুজো এসে গিয়েছে।
কিন্তু ৩০ বছরের সেই যাত্রাপথটা মোটেও সহজ ছিল না। ছিল কণ্টকপূর্ণ। গোড়ায় পুঁজি ছিল কম। তবে দু'চোখে ছিল অফুরন্ত স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে ছিল না কোনও খাদ। কঠোর পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে পূরণ হয়েছে সেই স্বপ্ন। গড়ে উঠেছে এক সাম্রাজ্য। হয়ে উঠেছে বাঙালির আশাপূরণের জায়গা। যাঁরা বাধার সামনে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন, তাঁদের কাছে ‘শ্রীলেদার্স’ হয়ে উঠেছে অনুপ্রেরণা।
আজ সেই কোলেপিঠে গড়ে তোলা ‘শ্রীলেদার্স’-এর পথ চলার কাহিনী শোনালেন শ্রীলেদার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সত্যব্রত দে এবং তাঁর স্ত্রী শ্রিপা দে।
শুরুটা কেমন ছিল?
সত্যব্রত দে: আমি যখন কলকাতায় এসেছিলাম, তখন হাতে পুঁজি বেশি ছিল না। কিন্তু দু'চোখে স্বপ্ন ছিল অঢেল। জুতোর বাজারে আমি দুটি ফাঁক খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রথমত, তখন বাজারে যে সব ব্র্যান্ডের জুতো ছিল, সেগুলির দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত, ভেন্ডর বা সাপ্লায়াররা অনিয়মিতভাবে জুতোর বরাত পেতেন। টাকাও পেতেন অনিয়মিত। তাই আমি কোনওক্রমে চালানোর সময়ও গুণমানের সঙ্গে কোনওরকম আপস করিনি। আমার ক্রেতারা যাতে সঠিক দামে গুণগত দিক থেকে সেরা জিনিস পান, তা নিশ্চিত করেছি। সেইসঙ্গে আমার সাপ্লায়ারদের নিয়মিত অর্ডার দিয়েছি। নিয়মিত মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের প্রাপ্য টাকা।
আমি একজোড়া প্যান্ট নিয়ে এসেছিলাম। ভিজে গেলেও সেটাই পরতে হত। দিনে একবার খেয়েই কাটিয়ে দিতাম। এক টাকায় তরকারি-সহ চারটি বা পাঁচটি রুটির জন্য হেঁটে বাবুঘাটে যেতাম। যা আয় করতাম, পুরোটাই ব্যবসায় বিনিয়োগ করতাম। আমি বাড়িও জোগাড় করে উঠেতে পারিনি। দোকানেই থাকতাম। ক্রমশ মানুষের মধ্যে আমাদের ব্র্যান্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষত দুর্গাপুজোর সময় জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে শুরু করে।
কীভাবে ব্র্যান্ড শ্রীলেদার্সের সঙ্গে আপনার পরিচয়?
শিপ্রা দে: ১৯৮৯ সালে আমাদের যখন বিয়ে হয়, তখন কী অবস্থা ছিল, তা আমি জানতাম না। এটাও জানতাম না যে ওঁর নিজের বাড়ি নেই। ওঁর বন্ধু এবং তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত আমিও ওঁকে ব্যবসায় সঙ্গ দিতে শুরু করি। যেহেতু আমি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম, তাই আর্থিক দিকটা দেখতাম। ক্যাশ কাউন্টার সামলাতাম। দুর্গাপুজোর সময় প্রথম উপচে পড়া ভিড় দেখেছিলাম। অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই ভিড়ই আমায় দ্রুত কাজটা শিখিয়েছে।
আপনার সংস্থার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটা? কোন বিষয়টার জন্য শ্রীলেদার্স আলাদা?
সত্যব্রত দে: আমাদের সংস্থার যে সংস্কৃতি আছে, সেটার সবথেকে বেশি কদর করা যায়। সেটাই আমাদের মূল মন্ত্র। আমার কাছে বিষয়টা একেবারে সহজ - আমাদের কর্মচারীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কর্মচারীদের স্বাস্থ্যের দিকে সর্বদা নজর দেওয়া হয়েছে। আমরা টিকাকরণ শিবিরের আয়োজন করেছিলাম। সেখানে আমাদের কর্মচারীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদেরও টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছিল। আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমাদের ১০০ শতাংশ কর্মীই টিকা নিয়েছেন।
শ্রীলেদার্সের পথ চলার মধ্যেই আমি এবং আমার স্ত্রী বিভিন্ন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে পেরেছি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির আগে এরকম প্রতিষ্ঠানগুলি আমাদের কোনও শাখায় আসত। আমাদের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিত। ভবিষ্যতেও এরকমভাবে চালিয়ে যেতে চাই।
ব্র্যান্ড শ্রীলেদার্সের ভবিষ্যৎ কী?
শিপ্রা দে: খুব ছোটো থেকে দুই সন্তানই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে আসছে। ওরা এখন সহজাত নেতা হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে মেয়ে (রচিতা দে, ডিরেক্টর) ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। ছেলে আপাতত বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত নয়া-নয়া জিনিসে ওর খুব আগ্রহ আছে। যা আমাদের সংস্থায় কাজে লাগানো যেতে পারে।