একদিকে সন্তানের ভালর জন্য সাধ্যের বাইরেও খরচে প্রস্তুত বাবা-মা। অন্যদিকে নিজের কেরিয়ারের উন্নতি করতে মরিয়া অল্পবয়সী কর্মী। দুইয়ের উপর ভর করে দেশের বৃহত্তম স্টার্টআপ-এ পরিণত হয়েছে Ed-Tech সংস্থা Byju's। তাদের এই বিশাল ভ্যালুয়েশন, বিজ্ঞাপনের আড়ালেই লুকিয়ে হাজার বিতর্ক, সমালোচনা।
২০১১ সালে বাইজুস-এর পথ চলা শুরু। সাধারণ টিউশন ও অনলাইন পড়ার ভিডিয়ো। তার থেকেই ২০১৫ সালে লার্নিং অ্যাপের গোড়াপত্তন। আর তারপর মাত্র ৭ বছর। তার মধ্যেই দেশের সবচেয়ে বড় ভ্যালুয়েশনের স্টার্টআপ সংস্থায় পরিণত হয়েছে Byju's । তবে ভ্যালুয়েশনই সার। দেশের অন্যতম বড় লোকসানকারী সংস্থাও বাইজুস। পড়ুন: সাড়ে ৪ হাজার কোটির লোকসানে BYJU's, ২,৫০০ কর্মী ছাঁটাই দেশের বৃহত্তম স্টার্টআপে
ঝাঁ চকচকে অফিস। দুর্দান্ত বেতনের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তাদের সেলস-এর পদ্ধতি, কোর্স কিনতে ক্রেতাদের বাধ্য করানো, গুণমানে খারাপ কোর্সই মোটা টাকায় বিক্রি করার মতো বিষয়গুলি বারবার উঠে এসেছে। সেলস কর্মীরা সংস্থার অভ্যন্তরে খারাপ ম্যানেজমেন্টের অভিযোগ করেছেন। Quora-র মতো জায়গায় অনেক প্রাক্তন কর্মীই তাঁদের কাজের করুণ অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানিয়েছেন। দিনে ১২ ঘণ্টার উপর কাজ, রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অ্যাপ ও ট্যাবের ডেমো দিতে পাঠানো, সেলস টার্গেট ছুঁতে না পারলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গালিগালাজ পর্যন্ত সহ্য করতে হয় কর্মীদের। কাজের প্রচণ্ড কঠিন পরিবেশ সামলাতে না পেরে অনেকেই কয়েক মাস পর ইস্তফা দিয়ে দেন।
হুগলীর শহরতলিতে থাকেন বাইজুসের এক প্রাক্তন কর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই যুবক জানালেন, বাইজুসের কোর্সগুলির দাম অনেকটাই বেশি। কোনও সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকার অনলাইন কোর্স কেনা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটাই করতে বলা হয় সেলসের কর্মীদের। প্রথমে ফোন করে সম্ভাব্য ক্রেতাদের সেলস পিচ দিতে বলা হয়। তাতে বলা হয়, কোর্সের পাশাপাশি বাইজুস একটি ট্যাবলেটও দেবে। এটি হলেই যথেষ্ট। বিশ্বসেরা মানের প্রশিক্ষণ পাবেন সন্তানরা।
এরপর তাঁদের বাড়ি গিয়ে ডেমো দেখানোর প্রস্তাব দিতে হয়। তাতে রাজি করাতে পারলেই কিছুটা শান্তি। সারা সপ্তাহ জুড়ে সেই কাজই করতে হয় সেলসের কর্মীদের।
এরপর সপ্তাহের শেষে ডেমোতে রাজি হওয়া অভিভাবকদের বাড়ি-বাড়ি যেতে হয় বাইজুস কর্মীদের। সেখানে নানা পন্থায় বোঝানো হয় যে কীভাবে এই অনলাইন কোর্স ছাড়া পড়ুয়াদের ভবিষ্যত অন্ধকার। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তরা তো বটেই, উচ্চবিত্তরাও এভাবে হঠাত্ ৪০-৫০ হাজার টাকার কোর্স নিতে ইতস্তত বোধ করেন। এরপর তাঁদের ঋণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
হুগলীর ওই প্রাক্তন কর্মী জানালেন, বেঙ্গালুরু, মুম্বইয়ের মতো স্থানে কোর্স বিক্রি করা তবুও সম্ভব। সেখানে মানুষের খরচ করার ক্ষমতা ও প্রবণতা বেশি। কিন্তু কলকাতা ও শহরতলির মানুষ এখনও অনলাইন কোর্সে এত খরচ করতে প্রস্তুত নন। তাছাড়া একটি মাত্র গ্রাহককে ডেমো দিতে ৫০-১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় সেলস কর্মীদের। বাইজুস সেই খরচ মিটিয়ে দেয় বটে। কিন্তু পুরো বিষয়টিই যে বেশ শ্রমসাধ্য, তা বলাই বাহুল্য।
এভাবে প্রতি মাসে সেলসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয় কর্মীদের। নির্দিষ্ট সেলসের মাত্রা পূরণ করলে তবেই মেলে ইনসেনটিভ। আর কোর্স বিক্রি করতে না পারলেই মেলে ম্যানেজারের বকুনি। সপ্তাহে অন্তত ১ লক্ষ টাকার কোর্স বিক্রি করার লক্ষমাত্রা দেওয়া হয় বাইজুস কর্মীদের। অর্থাত্ দাম অনুযায়ী ১-৪টি কোর্স বিক্রি করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মফস্বল এলাকায় এত টাকার অনলাইন কোর্স বিক্রি করা একেবারেই সহজ নয়। কোভিডের সময়ে যা-ও বা হত, এখন তা-ও হবে না। টিউশন ক্লাস খুলে গিয়েছে। অনলাইনের তুলনায় বরং সেখানেই খরচ করতে রাজি মা-বাবারা। বিশেষত বাইজুস-এর কোর্সেরও রিভিউতে অনেক নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে। পড়ুন: খারাপ স্টাডি মেটেরিয়াল, পরিষেবা - Byjus'-র থেকে প্রায় ১.৫ লাখ টাকা হাসিল ব্যক্তির
কর্মীদের অভিযোগ, সেলসে যে পরিমাণ খরচ ও জোর দেয় সংস্থা, তার ছিঁটেফোঁটাও প্রোডাক্টে দেওয়া হয় না। সেটা যদি করা হত, তাহলে কোর্স বিক্রি করতে এত দৌড়ঝাঁপ করতে হত না। গ্রাহকরা নিজেরাই কিনতেন। অনলাইনে বিভিন্ন কমেন্ট সেকশনেই দেখা যাবে, গ্রাহকরা বাইজুস-এর কোর্স নিয়ে গুচ্ছের অভিযোগ করে রেখেছেন।
কর্মীদের চাকরিও বেশ অনিশ্চিত। সম্প্রতি ২,৫০০ কর্মীকে ছাঁটাই করে বাইজুস। চরম লোকসানে ডুবে থাকা সংস্থা জানায়, লাভজনক হয়ে উঠতেই এই সিদ্ধান্ত। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর চেষ্টা এটি। আবেগঘন চিঠিতে ক্ষমাও চান সংস্থার সিইও বাইজু রবীন্দ্রন। আর তার পরপরই লিওনেল মেসির মতো বিশ্বসেরা ফুটবলারের স্পনসর হয়ে যায় সংস্থা। ফিফা বিশ্বকাপেও বিপুল টাকার স্পনসরশিপ দিয়েছে বাইজুস। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, খরচ কমানোই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে কর্মী ছাঁটাই কেন? অযথা বিজ্ঞাপনে রাশ কেন টানা হচ্ছে না? পড়ুন: 'লোকসানে'র জন্য কর্মী ছাঁটাই করে মেসিকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করল Byju's
যদিও বাইজুস-এর তরফে কর্মীদের অত্যাধিক চাপ দেওয়ার অভিযোগ নস্যাত্ করা হয়েছে। সংস্থার দাবি, কর্মীদের কখনই সপ্তাহে ৫ দিনের বেশি কাজ করতে জোর দেওয়া হয় না। কোনও কর্মী ছুটির দিনে কাজ করলেও সেটি তিনি স্বেচ্ছায় করেন। এর জন্য তাঁকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।