স্টেজে ম্যানেজ করতে গিয়ে ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ধরা পড়ে গেলেন রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি। এবারের হোম সিজনে চরম লজ্জার মুখে পড়লেন দুই মহাতারকা। এবারের হোম সিজনে রোহিতের গড় হল ১৩.৩। পাঁচটি ম্যাচে (১০ ইনিংসে) ১৩৩ রান করেছেন। সর্বোচ্চ হল ৭০ রান। অন্যদিকে, বিরাটের গড় হল ২১.৩৩। পাঁচটি ম্যাচে (১০ ইনিংসে) ১৯২ রান করেছেন। সর্বোচ্চ ৭০ রান। কিউয়িদের বিরুদ্ধে তিনটি টেস্টে ৯৩ রান করেছেন বিরাট। সেই ৯৩ রানের মধ্যে একটা ৭০ রানের ইনিংসও আছে। আর রোহিত করেছেন ৯১ রান।
তবে এটা যে একেবারে হঠাৎ হয়েছে, তা মোটেও নয়। ২০২০ সাল থেকে স্পিনারদের বিরুদ্ধে যে তাঁদের দুর্বলতা চলছে (অন্যান্য কারণও আছে), সেটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গিয়েছে নিউজিল্যান্ড সিরিজে। আর কী কী কারণে তাঁদের এরকম অধঃপতন হয়েছে, তা দেখে নিন।
রোহিত-বিরাটদের ত্রাস বাঁ-হাতি স্পিনার
২০২০ সাল থেকে টেস্টে রোহিত এবং বিরাটদের আউট করার ক্ষেত্রে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ হয়ে উঠেছেন বাঁ-হাতি স্পিনাররা। আর যখন দেশের দুই সেরা ব্যাটার এরকম কেঁপে যান, তখন ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। দেশের মাটিতে হামাগুড়ি দিতে হয়েছে ভারতীয় দলকে। ঋষভ পন্ত, স্পিনার, পেসারদের সৌজন্যে বেঁচে যাচ্ছিলেন এতদিন। কিন্তু এবার সেটা হল না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ১৩ বার বাঁ-হাতি স্পিনারের বিরুদ্ধে আউট হয়েছেন (২৫ ইনিংস) রোহিত। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সেই সংখ্যাটা ছিল সাত (১৯ ইনিংস)। গড় ৫১ থেকে কমে ২৯-র নীচের দিকে নেমে গিয়েছে।
অন্যদিকে, ২০২০ সাল থেকে বাঁ-হাতি স্পিনারের কাছে ১১ বার হার মেনেছেন বিরাট (৩১ ইনিংস)। আর এই বিরাট সেই ব্যক্তি, যিনি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাঁ-হাতি স্পিনারদের উপরে ছড়ি ঘোরাতেন। ৫২টি ইনিংসে মাত্র সাতবার আউট হয়েছিলেন। গড় ছিল ১১০-র উপরে। আর ২০২০ সাল থেকে সেই গড় কমে ৩৪-র নীচে চলে গিয়েছে।
সার্বিকভাবে স্পিনের বিরুদ্ধে দুর্বলতা
শুধু বাঁ-হাতি স্পিনার নন, সার্বিকভাবে স্পিনারদের বিরুদ্ধে রোহিত ও বিরাটদের দুর্দশা মারাত্মকভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে এশিয়ার মাটিতে ২৮টি ইনিংসের মধ্যে ২২ বার স্পিনারদের বিরুদ্ধে আউট হয়েছেন বিরাট। সার্বিকভাবে স্পিনারদের বিরুদ্ধে বিরাটের গড় ৫৪-র আশপাশে। সেখানে ২০২০ সাল থেকে সেটা কমে ৩০-র ঘরে চলে এসেছে। রোহিতের ক্ষেত্রেও ছবিটা পালটায়নি।
ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখা
রোহিত এবং বিরাট যে কেন ‘সচিন তেন্ডুলকর’ নন, তা সম্ভবত ঘরোয়া ক্রিকেট ম্যাচ খেলার পরিসংখ্যানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সচিন যখন নিজের শেষ রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলেছিলেন, তখন তাঁর টেস্টের সংখ্যা ছিল ১৯৮। সেখানে বিরাট এবং রোহিত রঞ্জি ট্রফির সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়েছেন, যখন তাঁরা সাকুল্যে ১৫টি টেস্টেও খেলেননি।
এবার অনেকে যুক্তি দেন যে সচিনের সময় এত ম্যাচ থাকত না, তিনটি ফর্ম্যাট ছিল না। এসব যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু বোলার (পড়ুন স্পিনার) যখন আউট করে দেবেন, তখন তিনি এটা বলবেন না যে এত চাপের মধ্যে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা হয়নি। ঠিক আছে, এটা আউট না। এটা ‘ট্রাই বল’। আবার দ্বিতীয়বার আউট হলে তখন ড্রেসিংরুমে ফেরত যাও।
আর ঘরোয়া ক্রিকেটে লাগাতার না খেলার ফলে স্পিন সামলানোর দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছেন বিরাট এবং রোহিতরা। যতটুকু স্পিন খেলেন, সেটা নেটে আর ম্যাচে। ফলে আগে ভারতের যেটা অস্ত্র ছিল, সেটা এখন দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে। আগে ভারতের মাটিতে টার্নার দেখলে বিদেশি দল কাঁপত। এখন স্পিনিং পিচে ভারতীয় দলই কেঁপে যায়। আর সবথেকে বড় ব্যাপার, তারপরও টার্নিং পিচে খেলার পথে হাঁটে টিম ইন্ডিয়া।
মাধ্যমিক পাসের পরে পারিপার্শ্বিক চাপে অনেকে যেমন একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে থাকেন এবং পরে সমস্যায় পড়েন, রোহিত-বিরাটদের ঠিক সেরকমই হয়েছে। আগে ভালো স্পিন খেলতেন বলে এখনও টার্নিং পিচের বরাত দেওয়া হয়। আর তারপর টার্নিং পিচে খেলতে নেমে হাবুডুবু খান।
টেস্টেও T20, ODI-র মতো খেলার চেষ্টা রোহিতের
২০২৩ সালের একদিনের বিশ্বকাপ এবং ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যেভাবে খেলেছেন, টেস্টেও সেটা খেলার চেষ্টা করছেন রোহিত। অর্থাৎ মেরে খেলতে হবে। আর সেটা করতে গিয়ে ডুবছেন। দ্রুত রান করে আউট হয়ে যাচ্ছেন। রানটা বেশি হচ্ছে না। যেন নিজের ডিফেন্সিভ শক্তির উপর থেকে পুরোপুরি ভরসা উঠে গিয়েছে রোহিতের।
ভারতীয় অধিনায়ক সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন যে তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের সেরা সময় যখন এসেছিল, তখন নিজের ডিফেন্সকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের কঠিন পিচে চারটি টেস্টে বল দেখে, সময় নিয়ে খেলেছিলেন। চারটি টেস্টে ৩৬৮ রান করেছিলেন। আর অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে রোহিতকে সম্ভবত সেই সিরিজের ভিডিয়ো দেখানো উচিত গৌতম গম্ভীরদের।