তিনি লেজেন্ড ছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯ জুনের পরে সেই লেজেন্ডের গণ্ডিটাও ছাপিয়ে গিয়েছেন। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে মহীরূহ হয়ে উঠেছেন জসপ্রীত বুমরাহ। আর মহীরূপ হয়ে ওঠা মানুষটার পিছনে যে কতটা লড়াই আছে, কতটা জীবন সংগ্রাম লুকিয়ে আছে, তা ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পরে জানালেন বুমরাহের দ্বিতীয় ‘মা’ তথা সাংবাদিক দীপল ত্রিবেদী। সোশ্যাল মিডিয়ায় বুমরাহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে গর্বের সঙ্গে তিনি জানালেন, বুমরাহ যখন ছোট ছিলেন, তখন এমন একটা সময় গিয়েছে, যখন তাঁকে একটা প্যাকেট দুধও কিনে দিতে পারতেন না। তারপরও ছেলেটা লড়াই করে বড় হয়েছে। কিন্তু কখনও উলটো-পালটা নেশা শুরু করেননি বুমরাহ। লড়াই করে গিয়েছেন। আর সেই লড়াইয়ের পুরস্কার হিসেবেই ঈশ্বর আজ তাঁকে সাফল্যে ভরিয়ে দিয়েছেন।
বুমরাহের মা তাঁর ‘বেস্টফ্রেন্ড’
দীপল বলেন, ‘১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরের একদিন আমার বেস্টফ্রেন্ড এবং আমার প্রতিবেশী একদিন ছুটি নিতে জোরাজুরি করেছিল। তখন আমার মাসিক বেতন ৮০০ টাকার কম ছিল। অন্তঃসন্ত্বা ছিল ও (বুমরাহের মা)। তখন আমার বয়স ওরকম ২২-২৩ হবে। আর আমদাবাদের পালদি এলাকার একটি হাসপাতালে দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যেত।’
প্রথমবার বুমরাহকে স্পর্শ
বুমরাহের দ্বিতীয় ‘মা’ বলেন, ‘আমার বন্ধু দলজিতের স্বামী জসবীর যখন কয়েক মিনিটের বাইরে গিয়েছিল, তখন নার্স আমাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছিলেন। আর আমার হাতে সদ্যোজাত শিশুকে তুলে দিয়েছিল। আমার হাত কাঁপছিল তখন। সেই প্রথমবার আমি কোনও সদ্যোজাত শিশুকে স্পর্শ করেছিলাম।’
সদ্যোজাত বুমরাহের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে আছে, তাতে বাচ্চাটা রোগা আর লম্বা ছিল। ও হাসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঠিক হাসছিল না। নার্স বলেছিলেন যে ছেলে হয়েছে। ও রোগা ছিল। দুর্বল ছিল। শীঘ্রই ওকে ডাক্তার নিয়ে নিয়েছিলেন। আমার বন্ধু খুব খুশি ছিল। আমি ওর (বুমরাহের মা) মেয়ে জুহিকার ধর্মমাতাও ছিলাম।’
বিপর্যয় নেমে আসে বুমরাহদের পরিবার, মারা যান বুমরাহের বাবা
দীপল বলেন, ‘শীঘ্রই ওর (বুমরাহের মা) স্বামী মারা যান। ওই মাসের পুরো সময়টা আমি বাচ্চাদের দেখভাল করেছিলাম। ওদের পড়িয়েছিলাম। ছেলেটার কোনওদিনই পড়াশোনায় ঝোঁক ছিল না। বরং সস্তায় কেনা প্লাস্টিক বল দিয়ে খেলতে শুরু করেছিল। মাঝেমধ্যে ওদের বিস্কুটও খেয়ে নিতাম আমি। কারণ ওদের দেখভালের মধ্যে আমার খাওয়া হত না। আমরা না খেয়ে থেকেছি। আমরা লড়াই করেছি। আমরা কেঁদেছি।’
'বুমরাহকে ১ প্যাকেট দুধও কিনে দিতে পারতাম না'
তিনি বলেন, ‘আমার দেখা সবথেকে সুন্দর শিশু হল জুহিকা। ওর হাসি এবং আলিঙ্গনের মধ্যে দিয়ে ও আমার মনে আশা জোগাত। কিন্তু ছেলেটার (বুমরাহ) লড়াইটা খুব কঠিন ছিল। আমরা ওকে আমূল ডেয়ারি বা অন্য কোনও দুধ কিনে দিতে পারতাম না। ও যখন বড় হচ্ছিল, তখন আমরা কোনওভাবে সংসার চালানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলাম। দিনে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা কাজ করত ওর মা।’
বুমরাহের বায়না, বুমরাহকে দেওয়া প্রথম গিফট
দীপল বলেন, ‘আমার মনে আছে, একবার আমার কিছুটা বেতন বেড়েছিল। আমি একটি মলে গিয়েছিলাম। আর সেখানকার সবথেকে দামি যে দোকানটা থেকে আমি কিছু কিনতে পারতাম, সেটা হল কুর্তার দোকান। মায়ের সঙ্গে ও সেখান গিয়েছিল। তখন কত বয়স হবে ওর, আট বছরের মতো। ওর একটা উইঞ্চেটার নেবে বলে বায়না করছিল। ওটাই ওকে দেওয়া আমার একমাত্র উপহার।’
সেইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নতুন কোনও কুর্তা ছাড়াই দীপাবলি, বড়দিন এবং জন্মদিন কাটিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে উইঞ্চেটার দেওয়ায় আমার এতটাই ভালো লাগছিল যে মনে হচ্ছিল আমি রাজদীপ রানাওয়াতের (ডিজাইনিং পোশাক) পরে আছি।’
৮ বছরের ছেলেটার মতোই এখনও মাটির মানুষ বুমরাহ
দীপল বলেন, ‘ও (বুমরাহ) ওর দিদির মতো ছিল না। ও (বুমরাহ) খুব লাজুক বাচ্চা ছিল না। বেশি কথা বলত না। আর ও এখন লেজেন্ড হয়ে উঠেছে। গত রাতে (শনিবার রাতে) বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রত্যেক ভারতীয়ের ওকে নিয়ে অবশ্যই গর্ববোধ করা উচিত আর ওকে দেখে শেখা উচিত। ও এখন সেই আট বছরের ছেলেটার মতো নম্র আছে। ওর নাম হল জসপ্রীত বুমরাহ।’
‘মদ-মাদকে ডুবে যেও না, বুমরাহকে দেখে শেখো’
আমি কালেভদ্রে কোনও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পোস্ট করি। কিন্তু এবার এটা আমি পোস্ট করতে চাইছিলাম। কারণ আমি চাই না যে কেউ জীবনে আশা ছেড়ে দিক, হতাশায় ডুবে যাক বা মদপ্যান করা বা অন্যান্য কিছু সেবনের মতো বাজে অভ্যেসের দিকে ঝুঁকে যাক। জসপ্রীত বুমরাহের কথা ভাবুন। ওর জীবন সংগ্রামের কথা ভাবুন। ঈশ্বর কীভাবে ওর জন্য সবকিছু পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা দেখুন। ঈশ্বর আমাদের সবাইকে সাহায্য করবেন। কিন্তু সেটার আগে নিজেকে সাহায্য করতে হবে।
আরও পড়ুন: ৪.১৭ ইকোনমি রেটে রান দিলেন বুমরাহ, ভেঙে দিলেন নারিনের ১০ বছর আগের T20 World Cup-এর রেকর্ড
বিশ্বকাপ ফাইনাল ‘দেখিনি, কিন্তু আই লাভ ইউ’
দীপল জানান, তিনি ক্রিকেটের কিছুই বোঝেন না। তাই বুমরাহের মায়ের জোরাজুরিতে শনিবার রাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে বসলেও ম্যাচটা আর দেখা হয়ে ওঠেনি। আর তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সরি জসপ্রীত, আমি তোর ম্যাচটা দেখতে পারিনি। কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসি।’
সেইসঙ্গে মজা করে দীপল জানান, তাঁর ‘বেবি’ বুমরাহও বাবা হয়ে গিয়েছেন। আর অঙ্গদ যদি ফুটবল খেলে, তাহলে নিশ্চয়ই দেখবে। যে অঙ্গদ নাকি ‘বেবি’ বুমরাহের থেকেও বেশি হ্যান্ডস্যাম বলে জানিয়েছেন ভারতীয় সুপারস্টারের দ্বিতীয় ‘মা’।
তাঁর পোস্ট ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, মন জিতেছে নেটপাড়ার
আর তাঁর সেই আবেগমাখা পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। নেটিজেনরা একেবারে আবেগে ভেসে গিয়েছেন। এক নেটিজেন বলেন, 'এই লেখাটা পড়ে আমার মনটা ভরে গেল একদম। কী সুন্দর কাহিনী। কোনও সাজানো-গোছানো ব্যাপার নেই। সত্যিটা তুলে ধরেছেন। ওঁ (বুমরাহ) প্রত্যেক ভারতীয়ের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। আরও বেশি কিছু পাওয়ার জন্য। আপনি ভাগ্যবান যে বুমরাহকে নিজের লোক বলতে পারছেন।'