‘সেমিফাইনালে’ কোন দল জিতবে? উত্তর মিলতে চলেছে কয়েক ঘণ্টা পরেই। বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) দেশের পাঁচটি রাজ্যের (গোয়া, মণিপুর, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড) বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশ হতে চলেছে।
তবে সবথেকে বেশি নজর আছে উত্তরপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের দিকে। উত্তরপ্রদেশে নরেন্দ্র মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথের ‘ডবল ইঞ্জিন’ ছুটবে নাকি সমাজবাদী পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় লোক দলের (আরএলডি) ধাক্কায় লাইনচ্যুত হবে, সেদিকে নজর আছে সারাদেশের। আবার পঞ্জাবের ভোটের ফলাফলের উপর দেশের বিজেপি বিরোধী জোটের 'মুখ' অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে মত সংশ্লিষ্ট মহলের।
উত্তরপ্রদেশ
২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে পুরোপুরি গেরুয়া ঝড় উঠেছিল। ৩৮৪ টি বিধানসভা আসনে লড়াই করে এককভাবেই ৩১২ টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। সার্বিকভাবে ৪০৩ আসন-বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি জোটের ঝুলিতে এসেছিল ৩২৫ টি আসন। বিএসপি জিতেছিল মাত্র ১৯ টি আসনে। সমাজবাদী পার্টি এবং কংগ্রেসের দখলে মাত্র ৫৪ টি আসন গিয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজবাদী পার্টির আমলে মুজফ্ফরনগরে যে হিংসা হয়েছিল, তার সুযোগ পেয়েছিল বিজেপি। নিজেদের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ছেড়ে সপার বিরুদ্ধে ‘হিন্দু’ হিসেবে ভোট দিয়েছিলেন হিন্দুরা। এবারও সেই প্রবণতা থাকবে কিনা, সেটার উপর বিজেপির সাফল্য অনেকটা নির্ভর করছে। কৃষি আইন (যদিও প্রত্যাহার করা হয়েছে) নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) এবং সপা জোট কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেদিকেও নজর আছে রাজনৈতিক মহলের।
যদিও একাংশের মতে, মাসছয়েক আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে কৃষকদের যতটা ক্ষোভ ছিল, কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাতে অনেকটাই প্রলেপ পড়েছে। সেই পরিস্থিতিতে কৃষকরা (হিন্দু কৃষকদের ধরে) ‘কৃষক’ হিসেবে ভোট দেবেন নাকি ‘হিন্দু’ হিসেবে ভোট দেবেন, তা উত্তরপ্রদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে। বিশেষত ২০১৩ সালের মুজফ্ফরনগরে হিংসার দাগ অখিলেশ যাদবদের গা থেকে এখনও ওঠেনি। সেইসঙ্গে সপার আমলে ‘আইন-শৃঙ্খলার অভাবের’ ইস্যুও বিজেপির কাছে হাতিয়ার হয়েছিল প্রচারপর্বে।
বুথফেরত সমীক্ষা: অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার আভাস যে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে চলেছে বিজেপি। ইন্ডিয়া টু'ডে+অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া বুথফেরত সমীক্ষায় তো আবার আভাস দেওয়া হয়েছে যে বিজেপি ফের ‘ট্রিপল সেঞ্চুরি’ করতে চলেছে। দেশবন্ধুর বুথফেরত সমীক্ষার আভাস, উত্তরপ্রদেশে ভরাডুবির মুখে পড়বে গেরুয়া শিবির। ২২৮ থেকে ২৪৪ টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে সপা জোট।
পঞ্জাব
২০১৭ সালের বিধানসভা ‘ফেভারিট’ ছিল আম আদমি পার্টি (আপ)। কিন্তু খলিস্তানি কার্ড ভুল খেলার মাশুল গুনতে হয়েছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের। ২০ টি আসনে জিতেছিল আপ। শিরোমণি অকালি দল এবং বিজেপি জিতেছিল ১৮ টি আসনে। অন্যদিকে, ১১৭ আসন-বিশিষ্ট রাজ্যে ৭০ টি আসনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস।
কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় এবার কংগ্রেসের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। একে তো ভোটের কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। তারপর আবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নভজ্যোত সিং সিধু এবং মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নির ‘লড়াই’ এমন চলেছে যে আপের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় মেলেনি। অথচ কংগ্রেসের হাতে যথেষ্ট সুযোগ ছিল। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক-বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগাতে পারতেন রাহুল গান্ধীরা। সেটা তো হয়নি। উলটে কৃষকদের একাংশ কংগ্রেসের উপর চটে আছেন। কংগ্রেসের শাসন নিয়ে খুশি হন যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল।
সেই ক্ষোভের জেরে ‘পরিবর্তনের’ হাওয়া উঠেছে পঞ্চনদের তীরবর্তী রাজ্যে। সেই হাওয়ায় ভর করেই পঞ্জাবে ঝাড়ু ঝড়ের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। একাংশের বক্তব্য, আপ যদি পঞ্জাবে জিতে যায়, তাহলে দেশের বিরোধী মুখের অভিমুখ অনেকটাই ঘুরে যাবে। বিকল্প হিসেবে কেজরিওয়ালই উঠে আসবেন।
বুথফেরত সমীক্ষা: প্রায় সব বুথফেরত সমীক্ষার আভাস, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে আপ। এমনকী চাণক্যের সমীক্ষায় তো আপ সেঞ্চুরি করতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস, অকালি বা বিজেপি - কেউই ঝাড়ু ঝড়ে টিকবে না বলে আভাস মিলেছে।
গোয়া
২০১৭ সালে 'দরজার পিছন দিক দিয়ে' বিজেপির বিরুদ্ধে গোয়ার মসনদে বসার অভিযোগ উঠেছিল। ৪০ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায ১৭ টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল ১৩ টি আসন। মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির (এমজিপি) মতো আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছিল গেরুয়া শিবির। দু'বছর হাত শিবির ছেড়ে ১৫ জন কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেন।
সেই পরিস্থিতিতে তাই আগেভাগেই ‘মিশন বিধায়ক’ শুরু করেছে কংগ্রেস। কারণ এবারও ত্রিশঙ্কু বিধানসভার আভাস মিলেছে বুথফেরত সমীক্ষায়। সেক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস এবং এমজিপির জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমজিপির সঙ্গে হাত মেলানোর কথা খোলাখুলি বলেই দিয়েছে বিজেপি এবং কংগ্রেস। তারইমধ্যে রাজনৈতিক মহলের মতে, আপাতত যা ইঙ্গিত, তাতে পৃথক দুটি দলের জন্য উত্তর এবং দক্ষিণ গোয়া ভোট করতে চলেছে। তবে গোয়ায় যে এক-একটা বিধানসভায় এতই কম ভোটার যে সেটাও বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।
উত্তরাখণ্ড
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর 'পরিবর্তনের' ধারা কি এবার দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে অক্ষত থাকবে নাকি সেই ধারা ভেঙে দেবে বিজেপি? উত্তরটা অনেকটাই কঠিন বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বুথফেরত সমীক্ষাও তেমন আভাস দিয়েছে। অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষা অনুযায়ী, কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। বাকি দলগুলি তেমন দাগ কাটতে পারবে না। ২০১৭ সালে সেখানে বিজেপি জিতেছিল ৫৭ টি আসনে। ৭০ আসন-বিশিষ্ট বিধানসভায় মাত্র ১১ টি আসন জুটেছিল কংগ্রেসের।
এবার অবশ্য পরিস্থিতি অনেকটাি আলাদা। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, ইভিএমে উত্তরাখণ্ডে বেকারত্ব, জীবনযাত্রার মান, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।সেগুলির জন্য বিজেপির যথেষ্ট চাপে থাকবে। তবে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বড় কৃতিত্ব পাবেন মোদী। কারণ আপাতত যা ইঙ্গিত, তাতে কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য মহিলাদের ভোটের বেশিরভাগটাই যেতে পারে বিজেপির দিকে। সেই মহিলা ভোটে ভর করেই রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে গেরুয়া শিবির।
মণিপুর
২০১৭ সালে কংগ্রেস বেশি আসনে জিতেছিল। ২৭ টি গিয়েছিল হাত শিবিরের দখলে। বিজেপির ঝুলিতে এসেছিল ২১ টি আসন। তবে 'খেলা' দেখিয়ে ৬০ আসন বিশিষ্ট মণিপুরে সরকার গড়েছিল বিজেপি। এবার বুথফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত, এবার উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সামান্য এগিয়ে আছে গেরুয়া শিবির। যে রাজ্যের নির্বাচনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (মৈতৈ, নাগা এবং কুকি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।