এবারের লোকসভায় চারশোর ওপর আসনে প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। আসানসোল হল এমনই একটি ব্যতিক্রমী আসন যেখানে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেও প্রত্যাহার করে নিতে হয় দলকে। ভোজপুরী অভিনেতা পবন সিংয়ের জায়গায় পাশের আসন থেকে জয়ী সাংসদ সুরন্দির আলুওয়ালিয়াকে এখানে নিয়ে আসে দল। সামনে বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। বহু জাতি ও ভাষার নিবাসী কসমোপলিটন আসানসোলের লড়াই যে এবার একেবারে জমে ক্ষীর, তা বলাই বাহুল্য।
আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রটি পশ্চিম বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি মূলত শিল্পাঞ্চল হিসাবেই প্রসিদ্ধ। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রটি পাণ্ডবেশ্বর, রাণীগঞ্জ, জামুরিয়া, আসানসোল উত্তর, আসানসোল দক্ষিণ, কুলটি এবং বরাবনি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। ১৯৫৭ সাল থেকেই এই লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হয়ে আসছে। আসনটি তফশিলি জাতি বা উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত নয়। ২০১৯ সালে এই কেন্দ্র থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির বাবুল সুপ্রিয় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, ১৪ লক্ষ ৬৯ হাজার ৬৬৬৮ জন ভোটদাতা গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে ভোটদান করেছিলেন। সিপিআইএম শক্ত ঘাঁটি এই কেন্দ্রে বর্তমানে নির্বাচনী লড়াই ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেই। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের সদর দফতর আসানসোল শহরেই অবস্থিত।
অতীতের ফলাফল ও প্রার্থী পরিচয়-
১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনে আসানসোল কেন্দ্র থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মনমোহন দাস জয়ী হয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের অতুল্য ঘোষ মধ্যবর্তী উপনির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়লাভ করেন। ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে অতুল্য ঘোষ ফের এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে সংযুক্ত সোশালিস্ট পার্টির দেবেন সেন এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এবং ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের পক্ষ থেকে রবীন সেন কংগ্রেসকে পরাজিত করে সাংসদ পদে নির্বাচিত হন৷ ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ লোকসভা নির্বাচনে ফের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আনন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় সিপিআইএমকে পরাস্ত করে এই কেন্দ্রে জয়যুক্ত হন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরপর তিনবার এই কেন্দ্রটিতে ভারতীয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর পক্ষ থেকে হারাধন রায় সাংসদ নির্বাচিত হন।
১৯৯৮ এর লোকসভা নির্বাচনে বিকাশ চৌধুরি সিপিআইএমের পক্ষ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস, অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার অনেকটাই কমতে থাকে। ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালেও বিকাশ চৌধুরি এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৫ সাল এবং ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বংশ গোপাল চৌধুরী সিপিআইএমের পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রে জয়ী হন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ৭৩ হাজার ভোটে বংশ গোপাল চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়যুক্ত হন। এই নির্বাচনে ৭১.৫ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে বাবুল সুপ্রিয় জয়যুক্ত হন ৭০ হাজার ৪৮০ ভোটে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৭৭.৭ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেন। গত লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে এই কেন্দ্র থেকে বাবুল সুপ্রিয় ফের একবার ১ লক্ষ ৯৭ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে। এই নির্বাচনে ৭০ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিল। বাবুল সুপ্রিয় ফের বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করলে এই আসনটিতে উপনির্বাচন হয়। উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা জয়ী হন। বাবুল তৃণমূলে যাওয়ার পর সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। সেই কারণেই ফের ভোট হয়। ২০২২-এ বিজেপির অগ্নিমিত্রা পালকে কার্যত দুরমুষ করে জিতেছিলেন শত্রুঘ্ন সিনহা।
এবার অবশ্য খেলা অতটা সোজা হবে, তা আশা করছে না কোনও পক্ষ। কিছুটা হলেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ বিজেপি। জিতেন্দ্র তেওয়ারি টিকিট না পাওয়াতেও স্থানীয় স্তরে ক্ষোভ ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে পাকা খেলোয়াড় এসএস আলুওয়ালিয়া অল্প সময়েই গুছিয়ে নিয়ে ভালো প্রচার করেছেন। তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদরা ময়দান জমিয়ে দিয়েছেন আসানসোল। হিন্দিভাষীরা চিরকালই বিজেপির শক্ত ভোটব্যাংক। তাদের ভরসাতেই এই লড়াইয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন আলুওয়ালিয়া। অন্যদিকে আছেন বিহারীবাবু শত্রুঘ্ন। প্রতিপক্ষকে ‘খামোশ’ করতে তাঁরও জুড়ি নেই। অতীতে ছিলেন বিজেপতেও। তবে এখনও পুরোপুরি জোড়াফুলে কমিটেড তিনি। ইন্ডিয়া জোটের পক্ষ থেকে জাহনারা খান আছেন লড়াইয়ে। তবে অতীতের সেই দাপট নেই, তাই মূলত কোন শিবিরের ভোট তিনি কাটবেন, সেটা নিয়েই কৌতুহল।
এবার ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা আসনটি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের নরেন্দ্র চক্রবর্তী ৩৮০০ ভোটে জয়ী হন। রাণীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তাপস ব্যানার্জি ৩৫০০ ভোটে জয়যুক্ত হন। জামুরিয়া কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস ৮ হাজারের বেশি ভোটে বিজেপিকে পরাস্ত করেন। আসানসোল উত্তর কেন্দ্রে মলয় ঘটক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২১ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হলেও আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্রটিতে বিজেপির তারকা প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল ৪৪৮৭ ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাজিত করেন। কুলটি কেন্দ্রটিতে বিজেপির অজয় কুমার পোদ্দার জয়যুক্ত হন। অন্যদিকে বারাবনি কেন্দ্রটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধান উপাধ্যায় ২৩ হাজার ৪০০ ভোটে জয়ী হন। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় থাকলেও ২০২১ সালের বিধানসভায় টক্কর হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির। শেষ পর্যন্ত প্রেস্টিজ ফাইটে কে জিতবেন, তা জানা যাবে ৪ জুন।