পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানের নেপথ্যে মোদী ঝড় ছাড়া যে ফ্যাক্টরটি নিশ্চিত ভাবেই কাজ করেছে, তা হল দিলীপ ঘোষের সাংগঠনিক ক্ষমতা। হাইকম্যান্ডের নির্দেশে এবার কেন্দ্র বদলে বর্ধমান-দুর্গাপুরে দিলীপ ঘোষ। বিপক্ষে বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ তৃণমূলের প্রার্থী। তাই শুধু যে রাজ্য নয়, দেশের নজর এই কেন্দ্রের ওপর থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। চতুর্থ দফায় ১৩ মে এখানে ভোটগ্রহণ করা হবে।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রটি পশ্চিম বর্ধমান জেলা এবং পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে অবস্থিত। এর অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র হল বর্ধমান দক্ষিণ, বর্ধমান উত্তর, মন্তেশ্বর, ভাতার, গলসি, দুর্গাপুর পূর্ব, এবং দুর্গাপুর পশ্চিম। এর মধ্যে বর্ধমান উত্তর এবং গলসি কেন্দ্রটি তফশিলি জাতির প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। বর্তমানে দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির এস এস আলুওয়ালিয়া সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তথ্য বলছে এই কেন্দ্রটিতে মোট ১৫ লক্ষ ৮৩ হাজার ৪৯৮ জন ভোটদাতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বর্ধমান দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রটি একটি তুলনামূলকভাবে নতুন লোকসভা কেন্দ্র। বর্ধমান এবং দুর্গাপুর শহরের মধ্যবর্তী গ্রামগুলি এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটারদের মধ্যে ৭২ শতাংশ গ্রামীণ ভোটার এবং অন্যদিকে ১৫ লক্ষ ৮১ হাজার ভোটারের মধ্যে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার মহিলা ভোটার রয়েছেন। বর্ধমান দুর্গাপুর একদিক থেকে যেমন এক সময় কৃষি কাজে উন্নত ছিল, তেমনই শিল্পাঞ্চল হিসাবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বর্তমানে কৃষি এবং শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই পূর্বের জৌলুস হারিয়েছে এই অঞ্চল।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএম প্রার্থী সাইদুল হক এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রটি থেকে ১ লক্ষ ৮ হাজারের বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে পরাজিত করেন তিনি। এই নির্বাচনে ৮৪ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ডঃ মমতাজ সংঘমিত্রা ১ লক্ষ ৭ হাজারের বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন৷ সর্বশেষ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির প্রার্থী এস এস আলুওয়ালিয়া। মাত্র ২০৪৯ ভোটে তৃণমূলের প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে ৭৬ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এবার অবশ্য সব পক্ষই প্রার্থী বদল করেছে। এখানে বিজেপির প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। প্রাথমিকভাবে জড়তা থাকলেও শেষের দিকে প্রচারে ঝড় তুলেছেন তিনি। বিজেপিতেও যে নব্য ও আদির মধ্যে লড়াই, সেখানে দিলীপ আদিদের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা, যার আরএএস ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সেই আদিদের অনেক নেতা, যারা আজ বিজেপিতে কিছুটা হলেও কোণঠাসা রীতিমত ঘাঁটি গেড়েছন এই কেন্দ্রে। দিলীপ যদি এই কঠিন কেন্দ্র থেকে জিতে দিল্লি যেতে পারেন, তাহলে তাদের প্রাসঙ্গিকতাও দলে কিছুটা বাড়বে এটাই আশা। অন্যদিকে অতীতে কংগ্রেসের জন্য অসফল ভাবে ভোটে লড়াই করা কীর্তি আজাদ এখানে তৃণমূলের সংগঠনের ওপর ভরসা করেই জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। অন্যদিকে সিপিএমের জন্য লড়াইয়ে আছেন সুকৃতী ঘোষাল। যদিও বাম প্রার্থী কার ভোট বেশি কাটতে পারবেন, সেদিকেই নজর থাকবে।
এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বর্ধমান দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলির ২০২১ সালের ফলাফল। বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে খোকন দাস তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৮১০৫ ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। বর্ধমান উত্তর বিধানসভা নির্বাচনে নীতিশ কুমার মালিক বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। মন্তেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৩১ হাজারের বেশি ভোটে জয়লাভ করেন। এছাড়াও ভাতার বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ৩১ হাজার ৭৪১ ভোটে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করেন। গলসি বিধানসভা কেন্দ্রের নেপাল ঘোড়ুই ১৯,২২৬ ভোটে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। দুর্গাপুর পূর্ব কেন্দ্রটি থেকে প্রদীপ মজুমদার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়ী হন। একমাত্র দুর্গাপুর পশ্চিম আসনটিতে লক্ষ্মণ চন্দ্র ঘোড়ুই ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে জয়ী হন ১৪ হাজার ৬৬৪ ভোটে৷
সার্বিকভাবে এই লোকসভা কেন্দ্রটিতে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি জয়যুক্ত হলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের হারানো জমি কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সবমিলিয়ে এই আসনে লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগামী দিনে বাংলায় বিজেপি কোন দিশায় এগোবে তারও ইঙ্গিত কিছুটা হলেও এই আসনের ফলাফল দেবে, বলেই মনে করা হচ্ছে।