ভেড়ি নীতি আনবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বসিরহাটের নির্বাচনী সভা থেকে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেউ জোর করে কারও জমি দখল করতে পারবে না। যার জমির উপর ভেড়ি রয়েছে সেই জমির মালিক যাতে লিজের টাকা পান তা সুনিশ্চিত করা হবে। এর পাশাপাশি সরকারকে ভেড়ি অনুযায়ী টাকাও দিতে হবে। সন্দেশখালির জমি আন্দোলনের জন্যই এই ঘোষণা মমতার, বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এই ঘোষণা শুনে সন্দেশখালির স্থানীয়দের প্রশ্ন, ভেড়ি পলিসি এলেও পুলিশ প্রশাসন কি চোখ খোলা রাখবে?
সন্দেশখালির এক বাসিন্দার কথায়, গত তিন-চার বছর ধরে শাহজাহানের দাপট বেড়েছিল এলাকায়। জোর করে জমি দখল নিয়ে নোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি বানানো, ঘটা করে চুক্তি করে লিজের টাকা না দেওয়া, চাইতে গেলে মারধর, এ সব বেড়েছিল খুবই দ্রুতার সঙ্গে।
শুধু তাই নয় নিজের মাছের আড়ত খুলেছিল শাহজাহান। ভেড়িতে যারা মাছ চাষ করতেন তাদের বাধ্য করা হতো শাহজাহানের আড়তে মাছ বিক্রি করতে। জোর করে মাছ ভর্তি ভ্যান নিয়ে যাওয়া হতো। না নিয়ে গেলেই শাহজাহান বাহিনীর মারধর। সেই ‘অত্যাচারে’ বাদ যেত না শাসকদলের কর্মীরাও।
আরও পড়ুন। আন্দোলনের সন্দেশখালিতে মুক্ত বাতাস নিচ্ছে শুধু বিরোধীরা নয় শাসকদলের একাংশও
স্থানীয় সিপিএম নেতা বলেন, ‘সন্দেশখালি আসলে ফিশারিপ্রবণ এলাকা। বিভিন্ন ব্লকে ব্লকে নোনা জলের ফিশারিজ রয়েছে। পাশাপাশি চাষও হতো। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সেই চাষের জমি দখল করে ভেড়ি তৈরি শুরু হল। শাহজাহান বাহিনী রোলার চালিয়ে পাকা ধান নষ্ট করে দিয়েছে। তার পর সেই জমিতে ভেড়ি তৈরি করেছে। লিজের টাকা কোনও বছর দিয়েছে, কোনও বছর দেয়নি।’ জোর করে অন্যের জমি দখল করে ভেড়িতে নদীর জল ঢোকানোর খাল করা হয়েছে।
কত টাকায় বিঘাপ্রতি লিজ দেওয়া হতো তা জানালেন এক ভ্যান চালক (যাঁর নিজেদের ভেড়িও আছে)। তিনি বলেন, ‘জমি লিজ বাবদ বিঘা প্রতি বার্ষিক তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও কিছু বেশ টাকাও দেওয়া হয়।’ অর্থাৎ কারও পাঁচবিঘা জমি থাকতে লিজ বাবদ একজন চাষি পাবেন পনের হাজার টাকা। আর আয়? ওই ভ্যান চালক জানালেন লিজের অর্থের কয়েক গুণ বেশি। বাগদার মিন ছাড়া হয় ভেড়িতে। এছাড়া নদীর সঙ্গে সংযোগকারী খালের মাধ্যমে চলে আসে ভেটকি ও অন্যান্য মাছ। সব মিলিয়ে বার্ষিক যা আয় হয় তা ধান বা অন্যান্য চাষের আয়ের থেকে অনেক বেশি। তাছাড়া কোনও বছর চিংড়ি উৎপাদন সেভাবে না হলেও মাছ চাষিকে লোকসানের মুখ দেখতে হয় না।
শাহজাহান ও তাঁর বাহিনী মাছের ব্যবসায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ফলানোর জন্য এই ছবিটাই পাল্টে দিয়েছিল। এলাকার অর্থনীতির চরিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল। এই আধিপত্যের দাপটে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন শুধু এলাকার আদিবাসী, অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বলরাই নয়, এলাকা আর্থিক ভাবে সবলদের মধ্যেও ক্ষোভ জমা হয়েছিল। তাই তাঁরও মদত দিয়েছিলেন আন্দোলনে। এমনটাই জানালেন এক স্থানীয় বাসিন্দা।
স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা, যার নিজেরও ভেড়ি রয়েছে, শাহজাহানের দাপটে তাঁরও কাজকারবার লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছিল। তাঁরাও চাইছিলেন বন্ধ হোক একচ্ছত্র আধিপত্যের দাপট।
আরও পড়ুন। সন্দেশখালির বিজেপি নেত্রী যোগ দিলেন তৃণমূলে, অস্বস্তির মাঝে ভাঙনে চাপে পদ্মশিবির
শুধু আড়তে মাছের দাম নয়, কোন মাছ বিদেশের বাজারে যাবে, তার দামই বা কি হবে সবটাই ঠিক করত শেখ শাহজাহান। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, শুধু দেশের বাজার নয় বিদেশের বাজারেও মাছ পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছে সে। সবটাই হতো তার নির্দেশে। বেচাল হলেই বাহিনীর হাতে বরাদ্দ ছিল ‘অত্যাচার’।
প্রশাসন কি জানত না? গ্রামের ওই বাসিন্দা বলেন, সবই হতো প্রশাসনের নাকের ডগায়। অভিযোগ জানাতে গেলে বলা হতো, আমুক নেতার কাছে যাও, তমুক নেতার কাছে যাও। আর শাহজাহান যদি জানতে পারত, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পুলিশে গিয়েছিল, তবে তো আর কথাই নেই।
স্থানীয় ওই সিপিএম নেতার কথায়, ‘বাম জামানায় এখানে সকলকেই জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। কেউ ভূমিহীন ছিল না। ন্যুনতম দশ কাটা জমিও পেয়েছে। কিন্তু অনেকে অজ্ঞতার কারণে জমি রেকর্ড করায়নি। সেই জমি শাহজাহান বাহিনী জোর করে দখল করছে। কিছু বলতে গেলে ওরা, বলছে তুমি জমির রেকর্ড দেখাও। তারা জমির রেকর্ড দেখাতে পারছে না। বিএলআরও অফিসে গিয়ে রেকর্ড করতে গেলে, আগে থেকে শাহজাহান বাহিনীর লোক গিয়ে আধিকারিকদের বলছে যে তুমি রেকর্ড করাবে না। এর ফলে ওরা পাট্টা পাওয়া জমি রেকর্ড করাতে পারছে না। এই যুক্তি দেখিয়ে লিজে নেওয়া জমির টাকাও দিচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তাই নয়, চাষের জমিতে লোনা জল ঢুকিয়ে ভেড়ি করে দেওয়ার ফলে আর নানা ভাবে ক্ষতি হয়। রান্নার জ্বালানি পাওয়া যায় না, গবাদি পশুর খাবার মেলে না, গরু মাঠে চরতে পারে না। ফলে সে যে গরু ছাগল পুষে সংসার চালাবে তাও পারে না।’
স্থানীয় তৃণমূল নেতা জানিয়েছে, আন্দোলনের পর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি আধিকারিকরা যখন সন্দেশখালিতে ক্যাম্প করেছিলেন, তখন সমস্ত পাট্টা দেওয়া জমি রেকর্ড করানো হয়েছে। নতুন করে পাট্টা দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাচক্রে যে দিন সন্দেশখালিতে এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলছি, সেই দিনই মুখ্যমন্ত্রী বসিরহাট থেকে ঘোষণা করছেন ভেড়ি নিয়ে ‘পলিসি’ আনার। শুনে এক গ্রামবাসী বললেন, ‘পলিসির সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনও যাতে চোখ খোলা রাখে সেটাও দেখতে হবে।’