২০১৯-এ বাংলার যে সব আসনের ফলাফল সবচেয়ে বেশি চমকে দিয়েছিল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের, তার মধ্যে অন্যতম হল হুগলি। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের খাসতালুকে জিতেছিল বিজেপি। তাও এমন কেন্দ্র, যার মধ্যে রয়েছে সিঙ্গুর। তৃণমূলের বাংলায় ক্ষমতা আসার নেপথ্যে সিঙ্গুরের অবদান প্রসঙ্গে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই এবার হুগলিতে জোড়াফুল ফোটাতে মরিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কারণেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী তথা সঞ্চালিকা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টিকিট দিয়েছেন তিনি। বিপক্ষে প্রাক্তন অভিনেত্রী তথা বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। এই প্রেস্টিজ ফাইট হতে চলেছে পঞ্চম দফার ভোটে, ২০ মে।
১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনটি থেকেই এই কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তথ্য বলছে এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার ৪২ জন। তফসিলি জাতি বা, উপজাতির জন্য সংরক্ষিত নয় এই কেন্দ্রটি। এই লোকসভার সদর দফতর হুগলি শহরে অবস্থতি। চন্দননগর, চুঁচুড়া, বলাগড়, পান্ডুয়া, সপ্তগ্রাম এবং ধনেখালি এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে হুগলি লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। এর মধ্যে বলাগড় এবং ধনেখালি বিধানসভা দুটি বর্তমানে তফশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত।
এক নজরে দেখে যাওয়া যাক, প্রথম লোকসভা নির্বাচন থেকে সাম্প্রতিকতম লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটির নির্বাচনী ফলাফল। ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রটি থেকে জয়ী হন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রার্থী নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জী। তবে এর পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনগুলিতে সিপিআই এবং সিপিআইএম-এর প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই-এর পক্ষ থেকে প্রভাত কর সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সিপিআইএমের পক্ষ থেকে বিজয় কৃষ্ণ মোদক জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থীদের হারিয়ে জয়ী হন। ১৯৮০ সালে এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন হুগলি জেলার তৎকালীন সিপিআইএম নেতা রূপচাঁদ পাল। ১৯৮৪ সালে এই কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেস সিপিআইএম এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, ইন্দুমতি ভট্টাচার্য সাংসদ নির্বাচিত হন। তবে, ১৯৮৯ সালের পরবর্তী দীর্ঘ সময় এই কেন্দ্রটি সিপিআইএম-এর শক্ত গড় হিসাবেই পরিচিত ছিল। ২০০৪ সাল পর্যন্ত পরপর ছ‘টি নির্বাচনে রূপচাঁদ পাল এই কেন্দ্রটি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।
২০০৯ সালে প্রথম এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস সফল হন ডঃ রত্না দে নাগের হাত ধরে। প্রসঙ্গত রাজ্য রাজনীতির পালাবাদলের শুরু হয় এই লোকসভা কেন্দ্র থেকেই। সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রভাবে বামফ্রন্টের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনের অবসান হয়। ২০১৪ সালে ফের একবার ডঃ রত্না দে নাগ সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে দেশজুড়ে গেরুয়া ঝড়ের মাঝে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতছাড়া হয় কেন্দ্রটি। ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে লকেট চট্টোপাধ্যায় এই কেন্দ্রে রত্ন দে নাগকে পরাজিত করেন। প্রসঙ্গত, বিজেপি’র জয় লাভের পেছনে এই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দীর্ঘদিনের জনসংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এবার দেখে নেওয়া যাক ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের ফলাফল৷ সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বেচারাম মান্না ভারতীয় জনতা পার্টির রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে হারিয়ে জয়ী হন। চন্দননগর বিধানসভা কেন্দ্রটি থেকে দীপাঞ্জন গুহকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ইন্দ্রনীল সেন বিধায়ক নির্বাচিত হন। চুঁচুড়া বিধানসভায় লকেট চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে তৃণমূলের অসিত মুখার্জি ফের একবার এই আসনটি জিতে নেন। বলাগড় বিধানসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সুভাষচন্দ্র হালদারকে পরাজিত করেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। পান্ডুয়া, সপ্তগ্রাম এবং ধনেখালি প্রত্যেকটি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পার্থ শর্মা, তপন দাশগুপ্ত এবং অসীমা পাত্র জয়ী হন। গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের হারানো ভোট বেশ খানিকটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
সেই মোমেন্টামটাই এবার তৃণমূল ধরে রাখবে, আশা করবেন রচনা। প্রচারপর্বে একাধিক ভাইরাল মিম হয়েছে তাঁকে নিয়ে। নানান কথায় বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে শেষ বিচারে রচনার গ্রহণযোগ্যতা ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ওপর ভরসা করেই জিততে চাইছে তৃণমূল। অন্যদিকে বিজেপির দাপুটে নেত্রী লকেট আশা করবেন যে গতবারের মত এবারও বামমনস্ক মানুষেরা অধিকাংশই বিজেপিকে ভোট দেবেন। অন্যদিকে অতীতে বামগড় হুগলিতে এবার প্রার্থী মনদীপ ঘোষ। বামেদের আশা কিছুটা হলেও জনসমর্থন ফিরছে তাদের দিকে। বামেরা যদি ভোট বাড়াতে পারে, তাহলে কার ক্ষতি হবে, সেটা ইভিএম খুললেই বোঝা যাবে ৪ জুন।