ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। এই কেন্দ্রটি বর্তমানে তফশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত। মোট সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে এই ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। কেন্দ্রগুলি হল গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম, বিনপুর, গড়বেতা, শালবনী এবং বান্দোয়ান। এই অঞ্চলে বেশকিছু আদিবাসী উপজাতি জনজাতির বসবাস। পশ্চিম মেদিনীপুর ছাড়াও ঝাড়গ্রাম এবং পুরুলিয়া জেলাতেও এই কেন্দ্রটি বিস্তৃত। গতবার এই কেন্দ্র থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির কুনার হেমব্রম সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য টিকিট না পেয়ে এবার তৃণমূলে যোগদান করেছেন। ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ছিলেন ১৪ লক্ষ ৭৫ হাজার ১১২ জন। ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটিতে ১৯৬২ সাল থেকেই লোকসভা ভোট পরিচালিত হয়ে আসছে।
এবার ঝাড়গ্রামে তিন নবাগত প্রার্থীর লড়াই। বিজেপি এবার স্থানীয় চিকিৎসক প্রণত টুডুকে প্রার্থী করেছেন। অন্যদিকে তৃণমূলের ভরসা পদ্মশ্রী ও সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কালিপদ ওরফে খেরওয়ার সোরেন। অন্যদিকে তরুণ নেত্রী বিয়ে করে ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় আসা সোনামনি মুর্মু টুডুকে প্রার্থী করেছে বামেরা। শেষ কয়েকবার নাটকীয় ভাবে খেলা ঘুরেছে এখানে। যদিও আগে এরকম ছিল না।
১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটি থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী ৪৫ হাজার ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। ১৯৬৭ সালে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী একে কিস্কু জয়ী হন। ১৯৭১ সালে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটি থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অমীয় কুমার কিস্কু ফের আরেকবার জয়লাভ করেন। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়ায় এই কেন্দ্রটি থেকে ৪৭ হাজার ৫০০ ভোটে জয়ী হয় ভারতীয় লোক দল। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রাখে সিপিআইএম। ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৯ পরপর তিনটি নির্বাচনে মতিলাল হাঁসদা এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে সিপিআইএমের রূপচাঁদ মুর্মু এই কেন্দ্র থেকে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালের নির্বাচনে পরপর পাঁচ বার রূপচাঁদ মুর্মু এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটি থেকে ২ লক্ষ ৯২ হাজার ভোটে জয়ী হয় সিপিআইএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয় সিপিআইএমের। তৃণমূল কংগ্রেসের উমা সোরেন ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ভোটে পরাজিত করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। দ্বিতীয় স্থানে নেমে আসে সিপিআইএম। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে ১১,৭০০-এর বেশি ভোটে পরাজিত করেম ভারতীয় জনতা পার্টির কুনার হেমব্রম। ঝাড়গ্রাম অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রাম এবং কৃষক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ন স্থান। বর্তমান সময়ে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির আধিপত্যই বিস্তার চোখে পড়ার মত।
এবার যদিও কুনার হেমব্রম নেই ময়দানে। বিজেপির সাংসদ তেমন ভাবে উপস্থিত থাকতেন না বলেই আক্ষেপ স্থানীয়দের। তার প্রভাব কি প্রার্থী বদলে কাটাতে পারবে গেরুয়া দল। সেটা নিয়েই মূল কৌতুহল। আদিবাসীদের জীবন, জীবিকার সমস্যাই এখানে মূল ইস্যু। আছে কুড়মি আবেগের প্রশ্নও। আদিবাসী নাগাচারি কুড়মি সমাজের বরুণ মাহাতো এখানে প্রার্থী। অন্যদিকে আদিবাসী কুড়মি সমাজ সূর্য সিং বেসরাকে ভোটে দাঁড় করিয়েছে। এরা কাদের ভোট কাটেন, সেই নিয়ে তুঙ্গে জল্পনা। হাতির উপদ্রব থেকে চাকরির অভাব, সব নিয়েই প্রচার হয়েছে চুটিয়ে। গত ভোটে বিজেপি অল্প মার্জিনে জিতলেও বিধানসভায় ছিল তৃণমূলের দাপট।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটির অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফল। গোপীবল্লভপুর বিধানসভা কেন্দ্রটিতে ডঃ খগেন্দ্রনাথ মাহাতো তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২৩ হাজার ৭০০ ভোটে জয়ী হন। ঝাড়গ্রাম বিধানসভা আসনটিতে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী বিরবাহা হাঁসদা ৩৮ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে। বিনপুর আসনটিতে দেবনাথ হাঁসদা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০ হাজার ভোটে জয়যুক্ত হন। বান্দোয়ান কেন্দ্রে রাজিব লোচান সোরেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ১৮ হাজার ৮০০টি ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। গড়বেতা কেন্দ্রটিতেও তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী উত্তরা সিংহ ১০ হাজার ৫০০ ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। শালবনি কেন্দ্রে শ্রীকান্ত মাহাতো তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী জয়ী হন ৩২ হাজার ৬৪৪ ভোটে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বিপর্যয় কিছুটা কাটিয়ে উঠে ২০২১-এর বিধানসভায় কেন্দ্রগুলির দখল নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। সার্বিক ভাবে জঙ্গলমহলের হারানো জমি কিছুটা ফিরে পায় তৃণমূল। সবমিলিয়ে এই আসনটি বিজেপির থেকে তৃণমূলের হাতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে ৪ জুন ইভিএম খুললেই চূড়ান্ত ফলাফল মিলবে।