সন্দেশখালি শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় সারা ভারতে বতর্মানে একটি আলোচিত নাম। পশ্চিমবঙ্গে এবার লোকসভা ভোটের অন্যতম ইস্যু, রাজনৈতিক তরজার বিষয়। সেই সন্দশেখালিতে রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থা কী, কেমন চলছে ভোটপ্রচার, বিরোধীরা কি প্রচার করতে পারছে, শাসকদলেরই বা অবস্থা কী? ভোটের আবহে খবর নিল হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা।
সন্দেশখালি ফেরিঘাট থেকে ত্রিমোণী বাজারের দিকে হেঁটে গেলেই বাঁদিকে পড়বে সিপিএম পার্টি অফিস। শাহজাহান শেখ এবং উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনও এসেছিলাম সন্দেশখালিতে। উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখেছিলাম। কাউকে দেখতে পাইনি। এবার দিয়ে গিয়ে দেখালাম পার্টি অফিসের বাইরের বারান্দায় একজন বসে আসেন। তাঁর সামনে রাখা ফ্লেক্স, পতাকা, কাগজপত্র। ছোট গ্রিলের দরজা খুলে আমার সঙ্গে আরও একজন ঢুকলেন। কথা বলে জানতে পারলাম, তাঁর নাম কৌশিক ভট্টাচার্য। তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছেন ভোটে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক হিসাব। তিনি জানালেন, প্রচার করতে গিয়ে তাঁরা দেখছেন মানুষ বেরিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত একটি দেওয়াল লেখাও সম্ভব হয়নি সিপিএমের পক্ষে। তবে এবার শাহজাহান ও সাঙ্গোপাঙ্গোরা বন্দি হওয়ায় অনেকটা সহজ হয়েছে প্রচার করা। কৌশিক ভট্টাচার্যর কথায়, এবার প্রায় শতাধিক দেওয়াল লেখা সম্ভব হয়েছে।
একটা সময় সিপিএমের দখলেই ছিল সন্দেশখালি। তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে এর মাটিতে। ২০২১ সালের পর ক্ষমতার দখল যায় তৃণমূলের কাছে। শেখ শাহজাহানের শাকরেদ উত্তম সর্দারেরর বাবা কালীপদ সর্দার এলাকায় সিপিএমের নেতা ছিলেন। শেখ শাহজাহানের সেই সময়কার কর্মকাণ্ড ছিল সিপিএমকে ধরেই।
কথা বলতে বলতে আরও দুজন এলেন পার্টি অফিসে। এঁদের মধ্যে একজন হোলটাইমার। নাম সুভাষ সর্দার। অন্যজন শিক্ষক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। নাম সন্তোষ কুমার বিশ্বাস। একটা সময় তিনি এলাকায় পার্টির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি এরিয়া কমিটির সদস্য।
আরও পড়ুন। ‘কলকাতায় এসে দেখলাম দেওয়াল লিখন মোছা হয় না’, উষ্মাপ্রকাশ করলেন প্রধান বিচারপতি
সুভাষ সর্দারের দিকে আঙুল দেখিয়ে সন্তোষবাবু বললেন, ‘ওকে বিধানসভা ভোটের সময় বেধড়ক মেরেছিল উত্তম সর্দাররা। এই পার্টি অফিসে ঢুকে মারে। খবর পেয়ে আমি দ্রুত স্কুল থেকে ছুটে আসি। পুলিশে অভিযোগ জানাতে যাই। কিন্তু রাস্তাতে আটকে দেয় উত্তমরা। বলল দাদা আপনি ফিরে যান।’
সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন, সন্দেশখালির আন্দোলন শুধু প্রশাসনের চোখ খুলে দেয়নি। মুক্ত বাতাস এনে দিয়েছে বিরোধীদলের জন্য। সুভাষ সর্দারের কথায়, যদি শাহজাহান এবং উত্তম, শিবুরা বাইরে থাকত তবে একটাও দেওয়াল লিখতে পারতাম না। তবে আগে আমাদের সঙ্গে কেউ কথা বলতে এলে আগে এদিক, সেদিক দেখে নিত, কেউ দেখছে কিনা। এই সেই ভয়টা আর নেই। তবে সবটা যে চলে গিয়েছে তা বলা যাবে না। মানুষের মনে একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করছে, জামিন পেয়ে আবার যদি ওরা ফিরে আসে…।’
আমি বললাম, ‘আগের মতো ওদের দাপট কি থাকবে? শুনে সুভাষবাবু বললেন, ‘তা থাকবে না। তবু…।’
কথা বলতে বলতে চলে এল লাল চা। কাগজের কাপে। টেবিলে পড়ে রয়েছে প্যাকেটে মোড়া মুড়ি। চা খেয়ে আবার হাটা লাগালাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
আরও পড়ুন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে উপকৃত ৮৫.৬ শতাংশ মহিলা, সমীক্ষায় উঠে এল বড় মাপের তথ্য
হাঁফ ছেড়েছে শাসকদলের একাংশ
খানিকটা হাঁটতেই মিলল তৃণমূল পার্টি অফিস। পাকা বাড়ি। ঝাঁ চকচকে। সেখানে জনা তিনেক লোক বসে রয়েছেন। ভিতরে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। ওঁরা বললেন, এখানে কথা বলার মতো কেউ নেই। জানালেন, আগে গিয়ে আর একটি অস্থায়ী অফিস তৈরি হয়েছে। ওখানে ব্লকের কনভেনার রয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। নিজেরাই ফোন করে জানিয়ে দিলেন আমার কথা। পার্টি অফিস থেকে থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগালাম।
রোদ্দুর বেশ চড়া। তবু কলকাতার মতো গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে না। হাঁটতে চলে গেলাম তৃণমূল কংগ্রেসের সেই অস্থায়ী অফিসে। সেখানে ছিলেন অচ্যুতানন্দন নস্কর। সন্দেশখালির অঞ্চল আহ্বায়ক। কংগ্রেসী পরিবারের ছেলে। তৃণমূল তৈরি হলে তিনি দলে যোগ দেন। মাছের ভেড়ি আছে। শাহজাহানদের দাপটে তিনি বসে গিয়েছিলেন। আন্দোলনের ফলে যখন এলাকার তৃণমূল নেতৃত্বেও পরিবর্তন করা হয় সেই সময় তাঁকে দায়িত্বে দেন পার্থ ভৌমিক। অচ্যুতানন্দনের দাবি, এক রকম জোর করে তাঁকে বসানো হয় আহ্বায়ক পদে।
এলাকার ভোটের হাল জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, ‘আস্তে আস্তে আবার পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। বুথে বুথে ভাল কাজ হচ্ছে। মানুষজনের আস্থা আমাদের উপর আবার ফিরে আসছে। সন্দেশখালির মানুষ বুদ্ধিমান। তাঁরা আসল নকল বোঝেন। জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া, নোনা জল ঢুকিয়ে জমি নষ্ট করে দেওয়া, এসবের বিরুদ্ধে মূল লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছে। মানুষ জমি ফিরে পাচ্ছেন। দিদি যে জমি পাট্টা দিচ্ছেন, পাট্টা রেকর্ড করার ব্যবস্থা করছেন এটা খুব কাজে এসেছে।’
স্থানীয় অন্য এক তৃণমূল নেতার কথায়, শাহজাহান ও তাঁর বাহিনীর দাপটে তৃণমূলের একাংশ কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। দলের যাদের ভেড়ি ব্যবসা ছিল তাঁদের ব্যবসাও লাটে উঠেছিল। তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনে তৃণমূলের ক্ষুব্ধ কর্মীরাও মদত দিয়েছিলেন। না হলে দেখলেন কোথায় কোনও কোনও রক্তপাত হয়েছে।’ তিনি বলতে থাকেন, ‘দলের দায়িত্বে থেকে কেউ যদি স্বৈরাচারী হয়, তখন তার বিরুদ্ধে মুখ থুলতে গেলে যে শক্তির দরকার, সেটাই তারা পাচ্ছিল না। ফলে প্রশাসনে যাব, না কি অন্য কোনো কোথাও যাব, কার কাছে গেলে একটা সুরাহা পাব, মানে মানুষ তখন দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। তার পর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একত্রিত হল, এই আন্দোলনটা হল। এটা সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোনো দলীয় আন্দোলন নয়। এটা কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ’
ত্রিমুখী লড়াই
ত্রিমোণী বাজারের মোড় থেকে খুলনা ফেরিঘাটের দিকে বেশ খানিকটা হাঁটতেই মিলল বিজেপি পার্টি অফিস। টালির চালে পার্টি অফিসের ভিতরটা বেশ পারিপাটি করে সাজানো। ভিতরে কেউ নেই। দরজা খোলাই রয়েছে।ওই পার্টি অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন বিপ্লব দাস। অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে থেকে তাঁর দেখা পাওয়া গেল না। তবে চারপাশে তৃণমূলের পতাকার সঙ্গে যে ভাবে পাল্লা দিয়ে বিজেপির পতাকা রয়েছে। তাতে বোঝাই যাচ্ছে সমান সমান টক্কর দিচ্ছে তারা। দেওয়াল লিখনেও তারা সন্দেশখালিতে তৃণমূলের সঙ্গে নিজেদের সমান ভাবে জানান দিচ্ছে। এমন কি পঞ্চায়তে ভোটে শিবু হাজরার নামে লেখা দেওয়াল দখল করে সাদা রং করেছে বিজেপি।
অথচ চার পাঁচ মাসে আগেও ছবিটা এমন ছিল না। এক আন্দোলন পাল্টা দিয়েছে ছবিটা। ভেঙে দিয়েছে ‘স্বৈরতন্ত্রের দাপট’। শুধু বিরোধী দলগুলি নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, নিচ্ছে শাসকদলের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া মানুষগুলো। লোকসভা ভোটে সন্দেশখালিতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের পথ প্রশস্থ করেছে জমি আন্দোলন।