সিঙ্গুরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া জাতীয় সড়ক নং ২ সংলগ্ন এলাকা জুড়ে এখন ঘাসে ভরা 'টাটার মাঠ'। সেখানে না হয় চাষ, না আছে টাটার পুরনো অর্ধনির্মিত কারখানার কোনও চিহ্ন। তবে সেই মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে একটি ঢালাই রাস্তা। সরু সেই রাস্তা ধরে ৫-১০ মিনিট গেলেই চোখে পড়বে একটি বিশাল বট গাছ এবং শিবমন্দির। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় এই বটগাছ নিশ্চিত ভাবে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবে সেই আন্দোলনের প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় পরে আজ সেই বটগাছকে জড়িয়ে রয়েছে আনকোরা নতুন লাল সুতো। গাছটিকে দেখে মনে হয়, সেখানে মানুষজন পুজো দিয়ে মানত করতে আসে। যেই মাঠের থেকে বাংলার শিল্প ভাগ্য ঘুরে যেতে পারত, এখন সেখানে বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশাল বটবৃক্ষ। এদিকে সেই ঢালাই রাস্তা পুরোটাই অন্ধকার। রাস্তার কোথাও কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। এই রাস্তা ধরেই সনাপাড়া থেকে বেড়াবেড়ি বা পূর্বপাড়া পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, এই বেড়াবেড়ি থেকেই সূচনা হয়েছিল সিঙ্গুর আন্দোলনের। (আরও পড়ুন: সিঙ্গুরনামা: NH2 দিয়ে ছুটবে স্বপ্ন? 'টাটাহীন' সিঙ্গুর তাকিয়ে NHAI'র কাজের দিকে)
আরও পড়ুন: সিঙ্গুরনামা: ন্যানো বন্ধ হলেও সানন্দে আছে কোকাকোলা-মাইক্রন; সিঙ্গুরে শুধুই হতাশা
আরও পড়ুন: সিঙ্গুরনামা: 'মানুষের বাড়ি ভেঙে কলকাতায় মেট্রো হয়, আর এখানে হয় আন্দোলন'
রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরানোকে কেন্দ্র করেই 'জনপ্রতিরোধ' গড়ে উঠেছিল সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, গোপালনগর এবং খাসেরভেড়ির মতো এলাকায়। এর মধ্যে বেশ কিছুটা জমি 'ছেড়ে দিতে' রাজি হয়েছিল টাটা গোষ্ঠী এবং রাজ্য সরকার। দাবি করা হয়, সেই জমি ছেড়ে দেওয়া হলে 'সমস্যা' থাকত আর মাত্র ৮০ একরের মতো জমি নিয়ে। এই আবহে বর্তমানে, সিঙ্গুর আন্দোলনের এক যুগ বাদে সেখানকার মানুষের অনেকেরই বক্তব্য, কিছুটা আমরা এগিয়ে এলে, কিছুটা ওরা এগিয়ে এলে এখানেই কারখনা হতে পারত। অনেকেই আবার নিজেদের 'ভুল' বুঝতে পারছেন। তাদের কথায়, আমাদের এখন বয়স বেড়েছে। আমাদেরে ছেলেপুলেরা আর চাষ করতে চায় না। তারা এখন কাজের খোঁজে কলকাতায় চলে যায়। তবে এখন যদি কোনও সংস্থার কারখানা হয়, তাহলে তাতে তাদের আপত্তি থাকবে না। (আরও পড়ুন: মিটবে দুর্ভোগ, বড় কাজ শেষ করল রেল, দমদম থেকে ট্রেনে চাপা যাত্রীদের জন্য স্বস্তি)
আরও পড়ুন: সিঙ্গুরনামা: টাটার জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল ১৬ লাখ টাকা প্রতি একরে,পরে কত বেড়েছে দাম
আবার সিঙ্গুরের এক টোটোওয়ালার কথায়, 'টাটার কারখানা এখন অপ্রাসঙ্গিক। এখন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের সম্প্রসারণের দিকেই তাকিয়ে সবাই।' সেই রাস্তা ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, পাশে বিশাল বিশাল সব ট্রাক, ডাম্পার থেকে শুরু করে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে ভিত তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে কর্মীরা নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। সেই দোকানে বসে থাকা বাকি খদ্দেররাও নিজেদের এলাকার উন্নয়ন, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেই আলাপচারিতায় ন্যানোর স্মৃতি উঁকি দিলেও টাটা এখন অপ্রাসঙ্গিক। তাঁদের কথায় স্পষ্ট, মোটা টাকা উপার্জন বা সংগঠিত সেক্টরে কাজ করতে হলে সেই কলকাতাতেই। তবে কখনও না কখনও সিঙ্গুরে ফের কোনও শিল্প হবে বলে আশাও রয়েছে তাঁদের মনে। (আরও পড়ুন: একলাফে অনেকটা চড়বে পারদ, বাংলার কোথায় হবে বৃষ্টি? কলকাতায় কতটা বাড়বে গরম?)
আরও পড়ুন: 'পণ্ডিতরা অবাক হবেন', দক্ষিণ ভারত, পশ্চিমবঙ্গে BJP'র ফল নিয়ে বড় দাবি মোদীর
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিঙ্গুরের এক এলআইসি এজেন্টের কথায়, 'এই যে বৌবাজারের নীচে দিয়ে মেট্রো লাইন তৈরি হচ্ছে। কত লোকের বাড়ি ভেঙেছে। তবে কাজ থামেনি। সেখানে কাজ থামাতে গেলে, আন্দোলন করতে গেলে উন্নয়নের নামে তা থামিয়ে দেওয়া হবে। আর সিঙ্গুরে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এখানে কারখানা হলে বর্তমান প্রজন্মকে কলকাতায় ছুটতে হত না কাজের জন্যে। আরামবাগ এবং হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের সীমানাবর্তী পাড়ায় বেশ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির গলাতেও হতাশা এবং চাহিদা। তাঁদের কথায়, জমি ফেরত তো পাওয়া গিয়েছে, তবে তা চাষযোগ্য নয়। কোনও সাধারণ কৃষকের ক্ষেত্রে এই সব জমি চাষযোগ্য করা সম্ভব নয়। অনেক জায়গাতেই চাষ হচ্ছে। তবে বহু জায়গায় করা যাচ্ছে না কৃষিকাজ। এই আবহে সরকারই একমাত্র পারে এই জমি চাষযোগ্য করতে। এই সব সাধারণ সিঙ্গুরবাসীর মনের কথা জানতে পেরে এটাই অনুমান করা যায়, 'টাটার মাঠে' দাঁড়িয়ে থাকা সেই বটগাছে মানত করা অনেকেই ভালো কর্মসংস্থান, উন্নয়ন বা ফেরত পাওয়া জমি যাতে চাষযোগ্য হয়ে যায়, তার জন্য প্রার্থনা করে থাকেন।