পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রটি আলোচনার কেন্দ্রে। শুধু বঙ্গ কেন, সারা দেশ দেখতে চায় প্রাক্তন বিচারপতি বনাম ভাইরাল গানের সৃষ্টিকর্তার লড়াইয়ে কে জেতেন। আছেন আরেক ভাইরাল বাম নেতাও ভোটের ময়দানে। তাই ২৫ মে-র ভোটে কী হয়, নজর সবার সেদিকে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, ময়না, নন্দকুমার, মহিষাদল, হলদিয়া এবং নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে তমলুক লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। এক সময় লক্ষ্মণ শেঠের শক্ত ঘাঁটি তমলুক লোকসভা কেন্দ্র সিপিএমের কাছ থেকে হাতছাড়া হয় নন্দীগ্রাম আন্দোলনের হাত ধরে। তবে বর্তমান সময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টির প্রভাবও চোখে পড়ার মতো। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা শুভেন্দু অধিকারীই এখন তৃণমূলের মূল প্রতিপক্ষ। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রটি ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই রয়েছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। তিনি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে জয়ী হলেও বর্তমানে তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ১৫ লাখ ২৭ হাজার ২৭৩ জন।
এবার বিজেপির টিকিটে প্রাক্তন হাইকোর্ট বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বনাম তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্যের লড়াই নিশ্চিত ভাবে হাড্ডাহাড্ডি হবে। সঙ্গে আছেন বামেদের তরুণ নেতা সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। কার ভোট শেষ অবধি কাটবেন সায়ন, তার ওপরেই হয়তো ভোটের চাবিকাঠি নির্ভর করছে। তৃণমূল-বিজেপি দুই পক্ষই কনফিডেন্ট। ভোটের আগে নন্দীগ্রামে খুন-খারাপি আরও উত্তাপ যোগ করেছে এই লড়াইয়ে। এছাড়াও দুই প্রার্থী একে অপরকে ছেড়ে কথা বলেননি, বরং রীতিমত ধারাল বাক্যবাণ আদানপ্রদান হয়েছে।
Watch: অভিজিৎ ‘জিরো’-ওয়েট, বাংলার সবথেকে দুর্বল BJP প্রার্থী, তমলুক থেকে হাওড়ায় এসে ভোট দেবাংশুর
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দুই দশকে এই কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেস এবং বাংলা কংগ্রেসের অধীনেই ছিল। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে সতীশচন্দ্র সামন্ত জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়ী হন। ১৯৬৭ ও ১৯৭১ এই দুটি লোকসভা নির্বাচনে সতীশচন্দ্র সামন্ত জয়যুক্ত হন বাংলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ভারতীয় লোক দলের সুশীল কুমার ধারা এই কেন্দ্রে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করেন। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী’র সত্যগোপাল মিশ্র কেন্দ্রটিতে জয়ী হন। ১৯৮৪, ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সাল পরপর চারবার সিপিআইএমের পক্ষ থেকে সত্যগোপাল মিশ্র এই কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সময়কালে কেন্দ্রটি যায় কংগ্রেসের দখলে। তবে ফের ১৯৯৮ সালে সিপিআইএমের পক্ষ থেকে লক্ষ্মণ শেঠ এই কেন্দ্রে জয়ী হন। ১৯৯৯, ২০০৪ এই দুটি লোকসভা নির্বাচনেও লক্ষণ শেঠ তাঁর নিজের গড় ধরে রাখেন। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন লক্ষ্মণ শেঠকে পরাজিত করে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারী ৭ লক্ষ ১৭ হাজারের কাছাকাছি ভোট পায় এবং সিপিআইএম শেখ ইব্রাহিম আলী ৪ লক্ষ ৭০ হাজারের কাছাকাছি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিব্যেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৯০ হাজার ভোটে জয়ী হন। এর পরবর্তী সময়ে শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান করার পর রাজ্য রাজনীতি এবং বিশেষত তমলুকের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশেষ বদল ঘটে৷ প্রসঙ্গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করে বিরোধী দলনেতা হন শুভেন্দু অধিকারী।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সৌমেন কুমার মহাপাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মাত্র ৭৯৩ ভোটে জয়ী হয়। পাঁশকুড়া পূর্ব কেন্দ্রটি থেকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী বিপ্লব রায়চৌধুরী ৯৬৬০ ভোটের মার্জিনে জয়যুক্ত হন। অন্যদিকে, ময়না আসনটিতে ভারতীয় জনতা পার্টির অশোক দিন্দা ১ হাজার ২৬০টি ভোটে জয়ী হন। নন্দকুমার, মহিষাদল এই দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস জয়যুক্ত হয়। অন্যদিকে হলদিয়া এবং নন্দীগ্রাম কেন্দ্র দুটি ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে তাপসী মন্ডল এবং শুভেন্দু অধিকারী নিজেদের দখলে রাখে। সবমিলিয়ে বিধানসভায় এখানে সমানে সমানে লড়াই হয়েছিল। লোকসভায় কী হয়, উত্তর জানতে অপেক্ষা ৪ জুন অবধি।