নন্দীগ্রাম থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী হওয়ার পর হাফ লাখ ভোটে হারাবার কথা শোনা গিয়েছিল বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর মুখে। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে যতই তিনি সভা করেছেন ততই তিনি বুঝতে পেরেছেন মুখে বলাটা যত সহজ, কাজে করাটা ততই কঠিন। কারণ প্রতিপক্ষ প্রার্থীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার রাজনৈতিক স্ট্যাচার শুভেন্দুর থেকে অনেক উপরে। তাই শুভেন্দুর জনসমর্থনের থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসমর্থন অনেকগুণ বেশি। সেটা নন্দীগ্রামই হোক বা ভবানীপুর হোক। এই পরিস্থিতি উপলব্ধি করে শেষমেশ মাঠে নামাতে হল শিশির অধিকারীকে।
কেন রাজনীতির ময়দানে এই বয়সে শিশির? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই প্রশ্নের খানিকটা উত্তর শুভেন্দু নিজেই দিয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘দইসাইতে তোলাবাজ ভাইপো এসে আমার বাপ তুলে কথা বলেছে। শিশির অধিকারী কে গালাগালি দিয়েছে। শুধু মোদীজির সভাতে নয় তার আগে ২১ মার্চ এগরাতে অমিত শাহের সভাতেও শিশিরবাবুকে থাকতে বলবো।’ কিন্তু এখানে যে কথাটা পরোক্ষে তিনি বলতে চেয়েছেন তা হল—এই হাইভোল্টেজ নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। আর এই ঝুঁকি থেকে মুক্তি দিতে পারেন রাজনীতিতে বর্ণময় চরিত্র শিশির অধিকারী। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক কুশীলবরা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী লড়াই শিশির বনাম মমতা? নরেন্দ্র মোদীর সভায় যাওয়া নিয়ে তাই তিনি বলেছেন, ‘আমাকে সুযোগ দিলে না যাওয়ার তো কিছু নেই।’ আবার কয়েকদিন আগে বলেছেন, ‘মমতা নন্দীগ্রামে লড়তে এসে মস্ত ভুল করেছেন। বাবা হয়ে কি ছেলের পাশে থাকা আমার কর্তব্য নয়।’ অর্থাৎ শুভেন্দুর পক্ষে একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠেকানো সম্ভব নয়।
এই সরগরম রাজনৈতিক পরিবেশে নন্দীগ্রামে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা আরও বড় আকার ধারণ করেছে রাজ্য–রাজনীতি। এতে বিপুল মানুষ বাংলার নেত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আর তাতে ভয় পেয়ে শিশিরবাবুকে মন্তব্য করতে হয়। শুভেন্দুর কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তখনই বোঝা গিয়েছিল রাজনীতির মাঠে ফিকে হচ্ছে শুভেন্দুর ক্যারিশ্মা। যার প্রমাণ মিলল নন্দীগ্রামে তাঁর গাড়ি ঢুকতেই গ্রামবাসীরা ঝাঁটা হাতে তেড়ে এলো সঙ্গে স্লোগান—‘চোর চোর চোরটা, শিশিরবাবুর ছেলেটা’। আর নেত্রীর আঘাত নিয়ে শিশিরবাবু বললেন, ‘যা কীর্তি করেছেন, তা বড় লজ্জার ব্যাপার। এটা জেলার পক্ষে লজ্জার। নন্দীগ্রামবাসীর পক্ষেও লজ্জার।’
কিন্তু কেন শুভেন্দুকে ভরসা করতে হল বাবা শিশির অধিকারীর উপর? শিশিরবাবুর রাজনৈতিক কেরিয়ার দেখলে দেখা যাবে—কাঁথি, অবিভক্ত মেদিনীপুর আর শিশির অধিকারী রাজ্য–রাজনীতিতে এক সময় সমার্থক হয়ে উঠেছিল৷ শিশিরের হাত ধরেই উত্থান শুভেন্দুর৷ ১৯৬৩ সালে প্রথমবার তৎকালীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কাঁথির ভবানীচকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন শিশির অধিকারী৷ ১৯৬৯ সালে প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন কাঁথি পুরসভায়৷ পরের বছরই কাঁথির পুরপ্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি৷ তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাম আমলেও দশকের পর দশক কাঁথির গড় আগলে রেখেছিলেন শিশির৷ ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমবার দক্ষিণ কাঁথি থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু ১৯৮৭ সালে দলীয় কোন্দলের জেরে তাঁকে টিকিট দেয়নি কংগ্রেস৷ কিন্তু কাঁথিতে তাঁর প্রভাব বোঝাতে অসুবিধা হয়নি শিশিরের৷ খোদ রাজীব গান্ধী প্রচারে এসেও কংগ্রেস প্রার্থীকে জেতাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এমনকী কংগ্রেসে থাকাকালীন ১৯৯৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী নীতীশ সেনগুপ্তের হারে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন শিশির অধিকারী৷ আবার ১৯৯৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর বিজেপি–তৃণমূল জোট প্রার্থী হিসেবে সেই নীতীশ সেনগুপ্তকেই কাঁথি থেকে জিতিয়ে এনেছিলেন তিনি৷ তৃণমূলের টিকিটে ২০০১ সালে ফের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি৷ ২০০৬ সালে যখন তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা কমে ৩০ হয়েছিল, সে বছরও নিজের দাপটে তৎকালীন বাম মন্ত্রী সিপিআইএমের প্রবোধ সিনহাকে এগরা থেকে হারিয়ে দিয়েছিলেন শিশির৷ ছেলে শুভেন্দুকে তুলনামূলক নিরাপদ আসন দক্ষিণ কাঁথি ছেড়ে দিয়ে প্রবোধ সিনহার গড় এগরাতে গিয়ে তাঁকে হারিয়ে এসেছিলেন শিশির৷ এবার বাবার সাহায্যেই জিততে চায় শুভেন্দু বলছে নন্দীগ্রামবাসী। কিন্তু এখন পথটা কঠিন বলেই দাবি সবার।