রাজভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। সেই ইস্তফাপত্র রাজভবনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে রাজ্যের শাসকদলের প্রতি নিজের ক্ষোভের কথা বলছিলেন তিনি। আর তখনই তাঁর বক্তব্যের শেষের দিকে কেঁদে ফেলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, ‘আমার হৃদয় অত্যন্ত ব্যথিত। আমি কখনও ভাবিনি যে আমাকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আমি নিয়েছি। যদি কাউকে কোনও আঘাত দিয়ে থাকি, যদি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকে, আমি হাতজোড় করে মার্জনা চাইছি। আমি মনে প্রাণে ভীষণভাবে আহত হচ্ছিলাম।’
ঠিক কবে থেকে দলের প্রতি ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেটাও এদিন খোলসা করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, সেচ দফতর থেকে তাঁর সরিয়ে দেওয়ার সময় তাঁকে দলের তরফে কিছুই জানানো হয়নি। সামান্য সৌজন্যতা দেখাননি দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজীব জানান, কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করার সময় টিভি দেখে তিনি জানতে পারেন যে তিনি আর সেচ দফতরের মন্ত্রী নন।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘সেচ দফতর ছাড়াও যে সব দফতরের দায়িত্ব আমাকে মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন আমি সবসময় নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রাড় আড়াই বছর আগে আমি সেচ দফতরে থাকাকালীন আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দফতর বণ্টন করা মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যে কোনও দফতরে গিয়েই ভালভাবে কাজ করা যায়। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছিল। আমি মুখ্যমন্ত্রী কাছ থেকে ন্যূনতম সৌজন্য আশা করেছিলাম।’
ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন? রাজীবের কথায়, ‘সেদিন আমি নিজে উত্তরবঙ্গে ছিলাম। মিটিং ছিল। এবং উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে দলীয় কার্যালয়ে বসেছিলাম। আমার সবথেকে খারাপ লেগেছিল যে আমাকে টিভি–তে ব্রেকিং নিউজে দেখতে হয়েছিল যে আমাকে সেচ দফতর থেকে অন্য দফতরে সরিয়ে দেওয়া হল। আমি অত্যন্ত এইটুকু সৌজন্য আশা করেছিলাম যে দলনেত্রী আমাকে জানাবেন। আর তার পরের দিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেব।’
রাজভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে রাজীব বলছিলেন, ‘এই আড়াই বছর অনেক অসন্তোষ, ক্ষোভ ছিল। সেই কথা আমি নেত্রীকে জানিয়েছি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও জানিয়েছি। কিন্তু বাইরে কখনও সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করিনি। গত ১–২ মাস আগে প্রকাশ্যে কিছু কথা বলে ফেলি। তার পরও আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু বিগত এক–দেড়মাস সহকর্মীরা আমাকে অনেক আহত করেছেন। হয়তো আজ আমি এই সিদ্ধান্ত নিতাম না। বিগত এক মাস আমি খুব আঘাত পেয়েছি। কোনওদিন ব্যক্তিগত আক্রমণ আমি করিনি। যাঁরা সেটা করছেন তাঁরা করে যেতে পারেন।’ এর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন নিজের বক্তব্যে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তিনি কতটা কৃতজ্ঞ সেই কথা জানিয়েছেন রাজীব। তাঁর কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি দীর্ঘদিন তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মী হিসেবে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এবং আমি মানুষের জন্য যা কাজ করেছি তার বিচার করবে মানুষ। কিন্তু এই কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আজ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে যদি কারও অবদান থাকে সেটা নিশ্চিতভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান। আমি যতদিন বেঁচে থাকব আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ এবং শ্রদ্ধাশীল থাকব।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিধায়ক বা মন্ত্রী হিসেবে জন্মাইনি। বিধায়ক বা মন্ত্রী হিসেবে মরবও না। কিন্তু আমি এটুকু মনে করি যে কাজের মাধ্যমে যদি কেউ মানুষের মধ্যে ছাপ ফেলে যায় সেটাই বড় কথা। চিরকাল কেউ একটা দফতরের মন্ত্রী থাকে না। আমি এর আগে সেচ দফতর, কারা দফতর, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর, অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ ও আদিবাসী উন্নয়ন দফতরে মন্ত্রী ছিলাম। সব দফতরের মতো বন দফতরের আধিকারিকদের সহকর্মী হিসেবেও কাজ করেছি। সকল সহকর্মীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। বন দফতরের কর্মীদের কিছু দাবিদাওয়া ছিল তা রাখতে পারলাম না বলে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের জন্য কাজ করে যাব। তবে কী প্লাটফর্ম পাব তা আমি জানি না।’