পয়লা এপ্রিল ভোট হতে চলেছে নন্দীগ্রামে। মঙ্গলবারই তার প্রচারপর্বে ইতি টেনেছে সব দল। তবে ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত নন্দীগ্রামেই থাকবেন বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়। তবে তার পরেও হুগলিতে দু’টি সভা করলেন তিনি। প্রথমে তিনি গোঘাটে সভা করলেন। তারপর সেখান থেকে গেলেন সিঙ্গুরে। দুপুরে সিঙ্গুরের প্রার্থী বেচরাম মান্নার বাড়ির কাছে রতনপুরে সভা করলেন তিনি।
সভা থেকে ছুঁয়ে গেলেন জমি আন্দোলনের সেই আবেগকে। মঞ্চে ডেকে নিলেন তৎকালীন সঙ্গীদের। রীতিমতো নাম ধরে ধরে খোঁজ নিলেন অনেকের। বললেন, ‘এখানকার সকলকেই তো চিনি আমি। নাম ধরে ধরে প্রত্যেককে জানি।’
এদিন দুপুরে হুগলিতে জোড়া সভা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চৈত্রের কাটফাটা রোদ মাথায় করে ভরদুপুরে এলেন সিঙ্গুরে। সভা থেকে এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে বেনজির সৌজন্য দেখালেন দলনেত্রী। সদ্য দলবদল করা মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে কড়া ভাষা প্রয়োগ করতেও দেখা গেল না—তাঁকে। বরং মাস্টারমশাইয়ের দলবদল নিয়ে তৃণমূল নেত্রী যে অবাকই হয়েছেন, তা স্পষ্ট তাঁর বক্তব্যেই। বললেন, ‘মাস্টারমশাই কীভাবে দাঁড়ান বিজেপির হয়ে? আমি অনুরোধ করেছিলাম, আপনাকে কোনও উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান করে দেব। সম্মানের সঙ্গে কাজ করবেন।’ মমতার ভাষণের পরতে পরতে ঝরে পড়ল মাস্টারমশাইয়ের উদ্দেশে শ্রদ্ধা। বললেন, ‘আমি আজও রবীন্দ্রনাথবাবুকে সম্মান করি।’ একইসঙ্গে বিজেপিকে কটাক্ষ করে তৃণমূল নেত্রী বললেন, ‘৯২ বছর বয়সের মাস্টারমশাইকে সেবা না—করে ভোটে দাঁড় করিয়ে দিল বিজেপি।’
এদিনের সভা থেকে সিঙ্গুরের আবেগ ছুঁয়ে গেলেন মমতা। জানালেন, ‘২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিঙ্গুর থেকে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। বেচারামকে বলেছিলাম, অন্য কোনও জায়গা থেকে মাস্টারমশাইকে দাঁড়ানোর জন্য বোঝাতে। কিন্তু উনি বুঝতে চাননি। সিঙ্গুর আমার আন্দোলনের জায়গা। সিঙ্গুর নিয়েও আমার আবেগ আছে।’ যদিও তৃণমূল নেত্রীর দাবি মানতে নারাজ সিঙ্গুরের বিজেপি প্রার্থী ‘মাস্টারমশাই’ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘উনি দাঁড়াতে চাইলে নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারতেন। বেচারামকে দিয়ে কেন আলোচনা করানো হল। উনি নিজে কথা বলতে পারতেন আমার সঙ্গে।’ তাঁর কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী আমাকে জিতিয়েছেন কি না জানি না, সিঙ্গুরের মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছেন।’
এদিনের সভা থেকে তিনি আরও জানান, ‘সিঙ্গুর আন্দোলনের জন্য সন্তোষী মায়ের ব্রত শুরু করেছিলাম, বলেছিলাম জিতলে সন্তোষী মাতার মন্দির করব। ক্ষমতায় আসার পর সেটা করে দিয়েছি।’ সব মিলিয়ে নন্দীগ্রামের নির্বাচনের আগের দিন ফের একবার জমি আন্দোলনের আবেগ ছুঁয়ে গেলেন মমতা।
অন্য দিকে, বুধবার হুগলি জেলায় প্রচারে আসছেন বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডাও। ধনেখালিতে সমাবেশ সেরে তারপর পুরশুড়ায় রোড-শো এ অংশগ্রহণ করবেন নড্ডা। আবার শনিবারই তারকেশ্বরে প্রচারে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার আগেই নিজের কেন্দ্র ছেড়ে হুগলিতে মমতার জোড়া সভা করলেন।
বলাই বাহুল্য যে, বিগত ১১ বছর আগে তৃণমূলের উত্থানের পিছনে নন্দীগ্রামের আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ঠিক তার বিপরীতে তৃণমূলের জমি শক্ত করতে এগিয়ে এসেছিল সিঙ্গুরও। সেকারণই এই নির্বাচনে দলের উত্থানের গড় নন্দীগ্রামে নিজেই প্রার্থী হয়ে এই আসনটিকে ‘হাইপ্রোফাইল’ বানিয়ে দিয়েছেন মমতাই। এই কেন্দ্রে একদা তার দলের কাণ্ডারি শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সম্মুখসমরে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। ঠিক সেইরকমই সিঙ্গুরেও এবার তার দলের প্রাক্তন সৈনিক তথা জমি আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা মুখের মধ্যে ভোট যুদ্ধ।একদিকে রয়েছেন বেচারাম মান্না অন্য দিকে, সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
শুধু নির্বাচন ঘোষণাই নয়, এমনকী তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার অনেক পরে বিক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথবাবু বিজেপিতে যোগ দেন। প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম না—থাকার কারণ হিসাবে তৃণমূলের তরফ থেকে জানানো হয় যে, সিঙ্গুরের বিদায়ী বিধায়ক রবীন্দ্রনাথের বয়সের কারণেই তাঁকে এবারে প্রার্থী করা হয়নি। সেই জায়গায় রবীন্দ্রনাথবাবুরই একদা স্নেহধন্য হরিপালের বিদায়ী বিধায়ক বেচারাম মান্নাকে এই আসনে প্রার্থী করেন মমতা। ঘটনার পর বেশ কয়েকদিন ধরেই দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই। দলের তরফ থেকে কোনও সদর্থক সাড়া না—পেয়েই তারপর বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। তবে গেরুয়া শিবির তাঁকে ফিরিয়ে দেয়নি। বরং ৮৯ বছর বয়সী মাস্টারমশাইয়ের ওপর আস্থা রেখে তাঁকে সিঙ্গুরের প্রার্থী করে বিজেপি। তার ফলে নির্বাচনের লড়াইয়ে সিঙ্গুরের জমিও হয়ে ওঠে ভোটযুদ্ধের তপ্ত ময়দান।
রবীন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গে বরাবরই ভাল সম্পর্ক ছিল মমতার। আগেও তিনি মাস্টারমশাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে এসেছেন। এমনকী, রবীন্দ্রনাথবাবুর দলবদলের পরেও তাঁর সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কোনওরকম মন্তব্য শোনা যায়নি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মুখে। আজও তা শোনা গেল না।