বড় বড় লাল রকওয়ালা বাড়ি, বিশাল ঝুল বারান্দা, লম্বা জানালা, বড় ছাদ আর তার চিলে কোঠায় লুকিয়ে থাকা কত অজানা সব গল্প, সেই রকের আড্ডা, এক হেঁশেলে রান্না। এমনই কত ছবি আজও আমাদের অনেকের মনেই হয়ত আলগোছে লেগে আছে। সেই ইটের পাঁজর বের হওয়া দেওয়ালেই মিলেমিশে আছে অনেকের ছোটবেলার স্মৃতি। আজও সেই সব বাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় ‘এলাটিং বেলাটিং সইলো/ কীসের খবর আইলো? রাজামশাই রাজামশাই একটি বালিকা চাইল/ কোন বালিকা চাইল?’
গল্প ও পর্যালোচনা
হ্যাঁ, সেই সব পুরনো দিনের ছড়াকেটে হাত ধরাধরি করে থাকা কতরকম খেলা। তবে যুগের নিয়মে সবই বদলে যাচ্ছে। উত্তর কলকাতার বড় বড় রকওলায় সেই শরিকি বাড়িগুলিতে এখনও ‘ইতিহাস ফিস ফিস কথা কয়…’। তবে কালের নিয়মে এমন বহু বাড়িই ভাঙা পড়ছে, তৈরি হচ্ছে লম্বা লম্বা ফ্ল্যাট, তার খুপরি খুপরি ঘর। আর এই সমস্ত বড় বাড়িগুলি ভেঙে পড়ার সঙ্গেই টুকরো টুকরো হয় যায় ছোটবেলার স্মৃতিরা। তখন হারিয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি হাতড়ানোর মতো সম্বলটুকুও হারিয়ে যায়। অনেকেই আজকাল পরিচর্যার সামর্থ্যের অভাবে এমন বড় বাড়ি প্রমোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এমনই এক পুরনো বাড়ি, একান্নবর্তীর পরিবারের গল্প বলল মানসী সিনহার ‘৫ নম্বর স্বপ্নময় লেন’।
যে বাড়ির বড় ছেলের মৃত্যুতে ছিন্ন বিচ্ছন্ন হয়ে যায় গোটা পরিবার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান ‘৫ নম্বর স্বপ্নময় লেন’ পরিবারের সদস্যরা। মাথার ছাদ হারান সেই বাড়িতে কাজ করতে এসে, সেটাকেই নিজের বাড়ি ভেবে নেওয়া মানুষগুলি। তবে এসব যখন ঘটে তখন সেই বাড়িরই দুই নাতনি ‘দুষ্টু’ আর ‘মিষ্টি’ অনেক ছোট। তবে প্রিয় সেই বাড়ি হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট বুকে চেপেই বড় হয়েছিল তারা। আর মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিল আবারও সেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। কারণ, সেই নোনাধরা দেওয়াল আর লাল মেঝে, বড় বারান্দাতেই আছে তাঁদের শান্তির চাবিকাঠি। কিন্তু তারপর?
দুষ্টু আর মিষ্টি কী পারবে বাড়ির সবাইকে তাঁদের সেই পুরনো ভিটে ফিরিয়ে দিতে? আবারও কি তারা তাঁদের হারানো শৈশবের স্মৃতিমাখা বাড়ি ফিরে পাবে? নাকি কালের নিয়মে সেই বাড়িতেও প্রমোটারদের থাবা বসেছে? এই সবের উত্তর মিলবে মানসী সিনহার ছবিতে। স্মৃতির গলি দিয়ে হেঁটে একবার তাই ঘুরে আসতেই পারেন '৫ নম্বর স্বপ্নময় লেন'-এ।
পরিচালনা
এধরনের স্মৃতির গলিতে হেঁটে, পুরনো বাড়ি আর একান্নবর্তী পরিবারের গল্প হয়ত আমরা আগেও বহুবার দেখেছি। তবে ছোটবেলার স্মৃতিমাখা এই পুরনো বাড়ির গল্পকে নিজস্ব মুন্সীয়ানায় একটু অন্যমোড়কে তুলে ধরেছেন পরিচালক মানসী সিনহা। নেহাতই সাদামাটা গল্প নয়, ছবির পুরনো দিনের গল্পকে আরও একটু নস্টালজিক করে তুলে সাদা-কালো ফ্রেমেই তুলে ধরেছেন পরিচালক। উঠে এসেছে বাড়ির জ্যেঠু-জ্যেঠিমা কাকা-কাকিমা, পিসি-পিসেমশাই, মাসী-মেসোমশাই, জা, ননদ, বউ, শাশুড়ি, নাতি-নাতনি, সকলের একসঙ্গে হইহই করে থাকা, একসঙ্গে বিশ্বকর্মাপুজোর আনন্দ করা, ভোগ রান্না থেকে খাওয়াদাওয়া, ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানো, ছোটদের খুনসুটি আর খেলা, রাতে বাড়ি ছেলেপুলেদের লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদে উঠে মদ্যপান, সিঁড়িদিয়ে নামতে গিয়ে চুপিচুপি প্রেম সহ আরও কত কী! আবার পুরনোকে ফেলে নতুন দিনের গল্প রঙিন মোড়কেই দেখিয়েছেন মানসী। এই ছবি নতুন-পুরনোর মিশেলে অতীত-ফেলে আসা স্মৃতিকে আকলেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।
এই ছবিতে পুরনো, অভিজ্ঞ জনপ্রিয় অভিনেতাদের পাশাপাশি নতুনদের নিয়েও কাজ করেছেন মানসী। তাই এই ছবিতে যেমনচন্দন সেন, খরাজ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, অর্জুন চক্রবর্তীর মতো দক্ষ অভিনেতারা রয়েছেন। তেমনই রয়েছে পায়েল মুখোপাধ্য়ায়, অন্বেষা হাজরার মতো দুই উঠতি অভিনেতা। এই দুই অভিনেত্রীও কিন্তু নিজ নিজ চরিত্রে অনবদ্য। ছবিতে 'দুষ্ট ও মিষ্টি', মামাতো, পিসতুতো এই দুই বোনের চরিত্রে দেখা গিয়েছে অন্বেষা ও পায়েলকে। গোটা ছবিতে এক ঝাঁক অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছেন পরিচালক। সকলেই নিজ নিজ চরিত্রে বেশ সাবলীল।
সবশেষে বলা যায়, বড়দিনে মুক্তি পাওয়া বাণিজ্যিক মশালাদার ছবিগুলির মাঝে, এই ছবিতে এক অনাবিল, নির্ভেজাল আনন্দের রসদ আছে। বলাই বাহুল্য ৫ নম্বর স্বপ্নময় লেন থেকে বের হওয়ার পরও আপনার মনেও স্মৃতিরা দাগ কেটে যাবে। আপনিও হয়ত দুষ্টু-মিষ্টির মতো করেই স্বপ্ন দেখতে শিখে যাবেন। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষণিক হলেও ওদের মতো করে ভাববেন, ‘যদি সবাই এইরকম ভাবে… তাহলে গোটা কলকাতায় যত ফ্ল্যাট আছে সব হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আবার সেই বড় বড় লাল রকওয়ালা বাড়িগুলো ফিরে আসবে, ওই বড় বড় ঝুল বারান্দা, বড় বড় ছাদ, বড় বড় জানালা… এই গোটা কলকাতাটা তখন আমাদের ছেলেবেলা হয়ে যাবে রে…।’ কিংবা হয়ত আপনারও ছোটবেলার স্মৃতিপট থেকে তখন উঁকি দেবে ‘এলাটিং বেলাটিং সইলো/ কীসের খবর আইলো?… ' মতো কোনও এক খেলা। ছোটবেলার স্মৃতিমাখা এই ছবিকে ৪/৫ দেওয়াই যায়।