খাওয়া, নাওয়া, বাথরুম সব বন্ধ
রেঁনোয়া, বিখ্যাত জার্মান চলচিত্র পরিচালক ভারতে এসেছিলেন ছবির কাজ করতে। সত্যজিৎ-এর তীব্র ইচ্ছে ছিলই তাঁর সঙ্গে কাজ করার, এবং কাজ শেখার। সত্যজিৎ রেঁনোয়াকে বলেন, তিনি ছবি বানানোর খুঁটিনাটি সব শিখতে চান, তাই অবজারভার হিসেবে এই ছবির সঙ্গে যুক্ত হতে চান। এখান থেকেই তাঁর সিনেমার জার্নিটা শুরু। শোনা যায় রেঁনোয়া যতদিন এখানে কাজ করেছিলেন মানিক বাবুও তাঁর সঙ্গে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো লেগে থাকতেন। একটা মুহূর্তও বৃথা যেতে দেননি। সেই সময় না ছিল নেট, না ছিল ওয়ার্ল্ড সিনেমা সম্বন্ধে জানার সুযোগ সুবিধা। তাই রেঁনোয়াকে মিস করতে চাননি। শুটিংয়ের সময় খাওয়া নাওয়া ভুলে পড়ে থাকতেন ফ্লোরে। রেঁনোয়া অবাক হয়ে যেতেন সত্যজিৎ এর ডেডিকেশন দেখে। তিনি মজা করে বলতেন, ‘ আরে মশাই আপনার কী বাথ্রুম টাতরুমও পায়না!’
ইচ্ছে হল বিশ্বমানের ছবি
তখন সত্যজিৎ লেখালেখি করছেন, ছবি আঁকাও ছিল, সেখান থেকে ছবি কেন? আসলে ওঁর মনে হয়েছিল, আমাদের দেশে, আর্ট, কালচার, সাহিত্য সহ বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে কাজ হলেও সিনেমার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে আমাদের দেশ। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাঁর ছবি বানানোর ইচ্ছেটা প্রকাশ পায়। এবং এইখানে তিনি তাঁর নিজের কাজের মূল জায়গাটা খুঁজে পাবেন। সুপ্রতিষ্ঠিতও হবেন। যে ছবি তিনি বানাবেন অবশ্যই তা বিশ্বমানের ছবি হবে। পাল্লা দেবে ওয়ার্ল্ড সিনেমার ময়দানে। এই ভাবনাতে প্রথম থেকেই কনফিডেন্ট ছিলেন।
আওয়ার ফ্লিমস, দেয়ার ফ্লিমস
‘আওয়ার ফ্লিমস, দেয়ার ফিল্মস’ থেকে জানা যায়, এই সিনেমা বানানোর ভাবনা থেকেই শুরু করলেন স্ক্রিপ্ট লেখার অভ্যেস। সিনেমা সংক্রান্ত প্রচুর পড়াশোনা, পাশাপাশি বড় পর্দায় সিনেমা দেখা। অন্ধকারে সিনেমা দেখতে দেখতে যদি কোথাও মনে হত এখানে অন্য রকম কিছু হলে আরও ভালো হতো, বা কোনও কিছু ডিম্যান্ড করছে তাহলে নিজের মনে হওয়াটাকে স্ক্রিপ্ট হিসেবে লিখতেন সেই সিনেমা চলাকালীন অন্ধকার হলে বসে। এই ভাবেই নিজেকে গড়েছেন ভেঙ্গেছেন বারবার। সেই সময় সিনেমা দেখা এত সহজ ছিল না, ভিডিও, সিডির তো কোনও প্রশ্নই নেই। নিজের তাগিদে জোগার করতেন দেশ বিদেশের সিনেমা।
ওই স্টিলটাকে একটু নাড়িয়ে দিলেই ভিডিও হয়ে যায়
সুব্রত মিত্রকে যখন বলেন, পথের পাঁচালীর জন্য তাঁকে ক্যামেরা করতে হবে, শুনে সুব্রত বাবু আকাশ থেকে পড়েন! উনি ছিলেন স্টিল ফোটগ্রেফার। সিনেমার ক্যামেরা করার কোনও অভিজ্ঞতা সেই সময় সুব্রত বাবুর ছিল না। কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেননা এতটা রিস্ক নিতে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ও ছাড়ার পাত্রও ছাড়ার পাত্র নন। সব শুনে খুব ক্যাজুয়াল ভাবে বলেন, এতে এত ভাববার কিছু নেই, ওই স্টিলটাকে একটু নাড়িয়ে দিলেই তো ভিডিও হয়ে যায়। এবং তাই হয়েছিল। শুরু হল অপু সিরিজ। বাকিটা ইতিহাস। একের পর এক মাস্টার স্ট্রোক! স্টিল ফোটোগ্রাফার থেকে হয়ে গেলেন সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র। বলাই বাহুল্য, দূরদর্শিতার অপর নাম সত্যজিত রায়।
সাকুরাভ এবং আইজেনস্টাইন
ওঁর পছন্দের আরও একজন ছিলেন রাশিয়ান পরিচালক সাকুরাভ। বারবার দেখতেন সাকুরাভের ছবি। সেই সময় আইজেনস্টাইন চলে এসেছেন। আইজেনস্টাইনের একটা মস্ত গুণ ছিল, তিনি যখন স্ক্রিপ্ট করতেন তখন পাতার বাঁ দিকে ছবি আঁকতেন। এটা জানার পর সত্যজিৎ এর মাথায় আসে যে, তিনিও তো ছবি আঁকতে পারেন তাহলে এটা যদি তিনি তাঁর চিত্রনাট্য লেখার সময় ছবি আঁকেন সেক্ষেত্রে একটা সুন্দর স্টোরি বোর্ড তৈরি হবে, যেটা খুবই কাজের। স্টোরি বোর্ড ডিটেলে থাকলে কাজ করতে অনেক সুবিধা হয়। অনেকেই জানি সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্য লেখার সময় বাঁ’দিকে ছবি এঁকে রাখতেন। এইরকম প্রচুর ঘটনা তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন। যেখান থেকে ওঁর সিনেমা চিন্তার ভিন্নতা সম্বন্ধে জানতে পারি।
সিনেমা শুরুর পাঁচালী
অপুর পাঁচালী থেকে জানা যায় কীভাবে তিলে তিলে তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন। সত্যজিৎ কিন্তু অনেক কিছুই জানতেন না। অথচ তাঁর শেখার নেশা এবং জেদ তাঁকে বিশ্ব সিনেমার দরবারে রাজার আসনে বসিয়েছে। তাঁর লেখা পড়লে অনেক ইচ্ছুক নতুন ছেলেমেয়ে সাহস পাবে সিনেমা তৈরি করার কাজে হাত লাগাতে। সিনেমা তৈরি করতে গেলে প্রথাগত শিক্ষা থাকতে হবে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়েছেন তিনি।
কন্টিনিউটি আর কখনও মিস হয়নি
পথের পাঁচালী শুরু করেছেন সবে। তার আগে রেঁনোয়ার সঙ্গে থেকে অনেকটা কাজ শিখলেও আরও অনেক কিছু শেখা বাকি রয়েছে। বোড়ালে শুটিং চলছে, উনি প্ল্যান মাফিক একের পর এক শট নেবেন এই ভাবেই সব সাজানো হয়েছে। প্রথম ভাগের শুটিং শেষ হওয়ার পর আবার বেশ অনেকদিন পর আবার হরিহরের ঘরের একটা দৃশ্য কন্টিনিউটি ছিল। সেটা শুট করতে গিয়ে মহা বিপদে পড়েন। ততদিনে ঘরের অবস্থা এবং আশপাশ সব কেমন বদলে গিয়েছে। একটা মিঠাই ওয়ালার দৃশ্য ছিল সেটা নিয়েও সমস্যায় পড়েন, কারণ ততদিনে সেই মিঠাই ওয়ালাও মারা গিয়েছেন। কিছুতেই আগের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না কন্টিনিউটি। এখান থেকে উনি শিখলেন কীভাবে অগের দৃশ্য পরে এবং পরের দৃশ্য আগে শুট করা যায়। এতে সময় এবং অর্থের অনেকটা সুরাহা হয়।
একজন স্বভাব মাস্টারমশাই
সারাটা জীবন ছবির মধ্যে দিয়ে খুব সহজভাবে বলে গেছেন শিক্ষামূলক বিভিন্ন বিষয়। একজন স্বভাব মাস্টার মশাই বাস করত ওঁর মধ্যে। ছোটদের জন্য হোক বা বড়দের জন্য হোক, কোথাও কোনও জটিলতা নেই তাঁর বক্তব্যে। অগ্রাহ্য করেন নি কোনও কিছুকেই। সত্যজিৎকে মনে প্রাণে উপলব্ধি করলেই অনেক কিছু শেখা যায়।
কোনও কিছুই বৃথা নয়
সালটা ১৯৮৯, ভারত বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে তৈরি ছবি 'বেদের মেয়ে জোৎস্না' সবে মুক্তি পেয়েছে। মারকাটারি হিট। এলিট বাঙ্গালীরা অবশ্য নাক সিঁটকে বলছেন, এত খারাপ ছবি ভাবা যায় না, এই ফিল্ম দেখলে তাঁদের জাত যাবে আরকি! এদিকে হলে টিকিটের জন্য মারামারি! কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বেদের মেয়ে জোৎস্না ইতিহাস তৈরি করল বাংলার বক্স অফিসে। সম্ভবত আজও টলিউডে এতবড় বানিজ্যিক সাফাল্য অন্য কোনও ছবি এনে দিতে পারেনি। তো সেই সময় একদিন সত্যজিত তাঁর ঘরোয়া আড্ডায় এই ছবির প্রসঙ্গ তুলে বলেন যে এই ফিল্মটি তিনি দেখতে চান, কী এমন আছে যার জন্য এতবড় সাফল্য! এলিট ক্লাস বাঙ্গালীর পছন্দ নাই হতে পারে। কিন্তু কমার্শিয়াল ছবির দর্শক আসলে কারা? যাঁদের পছন্দ অপছন্দের ওপর নির্ভর করে সিনেমার হিট ফ্লপ। এই টুকরো টুকরো ঘটনা গুলো থেকে বোঝা যায়, বিনোদন মাধ্যমের একজন মহান স্রষ্টা হতে গেলে সবার আগে মানুষের মনের ভেতরটাকে জানা দরকার। এই জানাটাকেই তিনি জয় করেছিলেন। তাই ভারতীয় সিনেমাতে তো বটেই, বিশ্ব সিনেমার দরবারে তিনি আজ শ্রেষ্ঠ অভিভাবকদের একজন।