আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে রাজ্য চারুকলা পর্ষদের পদ ছেড়েছেন চিত্রকর সনাতন দিন্ডা। আর এবার সেই একই পথে হাঁটলেন তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর প্রতিবাদে এবার চারুকলা পর্ষদের সদস্যপদ ছাড়লেন প্রদোষ পাল। ফেসবুকে নিজের পদত্যাগ পত্র শেয়ারও করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার নিজের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন শিল্পী। সেই পদত্যাগপত্র নিজের ফেসবুকের পাতায় শেয়ারও করেছেন শিল্পী। সেটির সঙ্গে প্রদোষ পাল ফেসবুকের ক্যাপশানে লেখেন, ‘আজ অফিসিয়াল পদত্যাগ পত্র জমা দিলাম। প্রসঙ্গত কয়েকটি কথা না বললে নয়। চারকলা পর্ষদ সম্পর্কিত নানান কুৎসা দেখে বুঝেছি কিছুই না জেনে এক শ্রেণি কোনও বিদ্বেষ বা হিংসা থেকে কথাগুলো বলছে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এরা সবাই আমার ঘনিষ্ঠ এবং চেনা জানা। সবাই সব জানার পরও সীমাহীন মিথ্যাচার ও কুৎসার বিরাম নেই। অভয়ার প্রতিবাদকে সামনে রেখে এই শ্রেণির উত্থান ভবিষ্যৎ সমাজ, বিশেষ করে শিল্প সমাজের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। আর যাই হোক এদের দ্বারা মানুষের কোনও মঙ্গল হওয়া সম্ভব নয়।’
প্রদোষ পাল আরও লেখেন, '২০১১ সালে পালাবদলের পর শিল্পী সমীর আইচের (Samir Aich) নেতৃত্বে চারুকলা কমিটি গঠিত হয়। অনেকের সঙ্গে আমার নামটিও সমীরদা ঐ কমিটিতে রেখেছিল সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে বহু কাজের সুযোগ পেয়েছি এই কয়েক বছরে। পরবর্তীতে সমীরদা পদত্যাগ করার পর সভাপতি হিসেবে যোগ দেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী ( Jogen Chowdhury Jogen Chowdhury)। যে কারণেই হোক তারপর চারুকলা পর্ষদের বার্ষিক আর্থিক-বরাদ্দ অনেকটা বাড়ে। তারই ফলে চারুকলা মেলার পাশাপাশি, তরুণ শিল্পীদের জন্য প্রতিযোগিতা মূলক প্রদর্শনী ও শিল্পী সম্মান প্রদান শুরু হয়।
অন্যান্য পর্ষদের কথা জানিনা কিন্তু এটা জানি চারুকলা পর্ষদের উপর বিন্দুমাত্র সরকার বা সরকারি আমলাদের প্রভাব ছিল না। এককথায় স্বাধীন একটি পর্ষদ। শিল্পী সম্মান এবং শিল্পী মহাসম্মান হিসেবে যাঁদের নির্বাচিত করা হয়েছে বা হয় যোগ্যতাই তাঁদের একমাত্র মাফকাঠি, দ্বিতীয়ত বয়স। এখন পর্যন্ত ষাটোর্দ্ধ শিল্পীদেরই এই সম্মানের আওতায় আনা হয়েছে। বিন্দুমাত্র সুপারিশ বা দলীয় রঙ দেখা হয়নি। জোর দিয়ে বলতে পারি সদস্যদের একজনেরও তৃণমূল দলের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। প্রত্যক্ষভাবে কেউ দলীয় রাজনীতি করেন না।'
প্রদোষ পাল আরও লেখেন, ‘সবাই জানেন চারুকলার সদস্য থেকেও আমি কতবার কতভাবে এই সরকারের অন্যায় নিয়ে সরব হয়েছি। যেজন্য আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে বিন্দুমাত্র সাবধান করেনি। সভাপতি হিসেবে যোগেন চৌধুরী সাবধান করা তো দূরের কথা প্রতিবাদী বলে আমাকে বেশি পছন্দ করেন। প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে ওঁকে নিয়ে কি পরিমান কুৎসা করে চলেছে কিছু মানুষ। জানি শিল্প নিয়ে এদের না আছে কোনো ধারণা, ত্যাগ এবং না আছে শিল্প চর্চার নিয়মিত অধ্যাবসায়। এই অর্ধ শিক্ষিতরাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক।’
প্রদোষ পালের কথায়, 'যাই হোক, বেশি কথা বলতে চাইনা। তবে এটুকু বলি এই মানুষটিকে কাছ থেকে দেখেছি, বুঝেছি বলেই জানি ওঁর আসন হাজার কুৎসাতেও কেউ টলাতে পারবে না। আমি ধন্য এই কয়েক বছর ওঁর পাশে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে চারুকলার প্রকাশনা বিভাগ থেকে এই ক'বছর যে সব পুস্তক, পুস্তিকা, পত্রিকা, অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে, যার ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। ব্যাক্তিগতভাবে এই কাজের থেকে বঞ্চিত হলাম এটা মানতেই হবে। সেই সঙ্গে বঞ্চিত হলাম এমন কিছু মানুষের বার্তা সদস্য হিসেবে পৌঁছে দিয়ে কিছু অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলাম তার সুযোগ থেকেও। শিল্পীদের পক্ষে সোচ্চার হয়ে অনেক দাবী পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম এই কয়েক বছর অনেকেই জানেন না।'
প্রদোষ পাল আরও লিখেছেন, 'একটা উদাহরণ দিই, আগে চারুকলা মেলায় স্টল প্রতি ৫০০০ ও ৩০০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হতো। আমার আবেদন মেনে বেশ কয়েক বছর যাবদ বিনামূল্যে স্টল বিতরণ করা হয়। কলকাতার বাইরে থেকে মেলায় যোগদানের জন্য শিল্পীদের যাতাযাতের খরচের ব্যবস্থাও হয়েছে আমার পরামর্শে। শেষ করি আর একটা মিথ্যাচারের জবাব দিয়ে। অনেকের ধারণা চারুকলার সদস্যরা প্রচুর ক্ষীর খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এবং সে জন্যই তারা পড়ে রয়েছে।
ক্ষীরের একটু নমুনা দিই.....
সদস্যদের মিটিং প্রতি গাড়ি ভাড়া হিসেবে দেওয়া হতো ৩০০ টাকা, গত দুবছরে বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা। আমি যেখানে থাকি সাধারণ ট্যাক্সিতে এখন ৩০০/৩৫০ টাকা লাগে। যাতাযাতে কত খরচ হয়, এবং নিজের গাঁট থেকে কত যায় হিসেব করে নিন। দূর দুরান্ত থেকে যে সব সদস্যদের মিটিংয়ে আসতে হয় ক্ষীর তো দূরের কথা নিজের পকেটের কত গচ্চা দিতে হয় তাও একবার ভেবে দেখুন। এছাড়া চারুকলার নানান প্রোগ্রামে সদস্যদের আসতে হয় সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে। গাড়ি ভাড়ার ৪০০ টাকা ছাড়া আর একটা টাকাও পারিশ্রমিক পাননা কোনও সদস্য।
এখন পর্যন্ত ৮০/৮৫ জন শিল্পী চারুকলা সম্মান পেলেও বহু যোগ্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পী চারুকলার সদস্য রয়েছেন। অথচ তাঁদের একজনও ঐ পুরষ্কার গ্রহণ করেননি। তাঁরা নির্বাচিত করেন কিন্তু যোগ্য হওয়া সত্বেও নিজেরা গ্রহণ করেননি। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এর পরও নানান ভাবে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষীর খাওয়ার অভিযোগ ওঠে, ক্রমাগত এক শ্রেণি কুৎসা করে যায়, আর এক শ্রেণি বিনা প্রতিবাদে পরিচিত বন্ধুদের নামে কুৎসা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। যদিও আমার সদস্যপদ ছাড়ার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। কেন ছাড়ছি চিঠির কয়েকটা লাইনেই তা স্পষ্ট। সেদিন একজন সিনিয়র দাদা বলছিল, এখন এসব কথা না লিখতে, এতে নাকি নিজেদের ইউনিটি নষ্ট হবে। এখন সবার জোট বাঁধা জরুরি।'
প্রদোষ পালের কথায়, ‘আমি এমনটা একেবারেই মনে করিনা। ভেতরে যাদের ময়লা আর যাই হোক তাদের দ্বারা ময়লা পরিষ্কার হয়না। সে পরিষ্কারে কোনো কাজ হয়না! আগেও বলেছি আবার বলছি আর যাই হোক এদের জাস্টিস চাওয়ার কোনও অধিকার নেই। রাজনৈতিক ভণ্ডদের মতো এরা আর এক ধরনের ভণ্ড। সংখ্যায় কম হোক কিন্তু পরিষ্কার মানুষরা এগিয়ে আসুক চাই।’
এদিকে প্রদোষ পাল যে চিঠির বয়ান শেয়ার করেছেন, তাতে রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সভাপতি যোগেন চৌধুরীর উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, 'সাম্প্রতিক আর জি কর হাসপাতালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অগণিত মানুষের মতো আমার মনও ভালো নেই। সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে আমিও পারি না এর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের অগণিত মানুষের যা দাবি, আমার দাবি একই, ঘটনার প্রকৃত সত্য প্রকাশ্যে আসুক, নেপথ্যের দোষীরা যথোপযুক্ত শাস্তি পাক। স্বাভাবিকভাবেই এমতাবস্থায় এই সরকারের কোনও পর্ষদের সঙ্গে আমার নাম যুক্ত থাকুক চাই না। আমার একান্ত অনুরোধ, রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সদস্য পদ থেকে আমার নামটি বাদ দেওয়া হোক। আজ থেকে এই বিভাগের কোনও সদস্য পদে থাকতে চাই না। আমার আবেদন মঞ্জুর হলে বাধিত থাকব।'